You are currently viewing ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার ফল
ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার ফল

ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার ফল

ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার ফল

এখন দেখা দরকার এই জাতিটিকে পরাজিত কোরে দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ কোরে তাদের আল্লাহ প্রদত্ত আইন-কানুন নিষিদ্ধ কোরে মোশরেক ও কাফের বানানোর পর ইউরোপীয়ান জাতি গুলি তাদের প্রভুত্ব স্থায়ী করার জন্য কি কি ব্যবস্থা নিলো। এই নতুন প্রভুরা বোকা ছিলো না। তারা ভালোকোরেই জানতো যে, কোন জাতিকে তারা শৃঙ্খলিত কোরতে পেরেছে এবং কেন পেরেছে। বুদ্ধিমান শত্রু বুঝছিলো যে, যে জাতির সামনে
তারা একদিন ঝড়ের মুখে শুকনো পাতার মত উড়ে গিয়েছিলো তাদের তারা আজ পদানত কোরতে পেরেছে, কারণ জাতিটি তাদের জন্য যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট কোরে দেয়া ছিলো তা থেকে ভ্রষ্ট হোয়ে গিয়েছে এবং ঐ লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার ফলশ্রুতিতে তাদের বহির্মূখী ও বিস্ফোরণমুখী চরিত্র পরিবর্ত্তীত হোয়ে অন্তর্মূখী হোয়ে জাতির গতি রুদ্ধ হোয়ে স্থবির হোয়ে গিয়েছে এবং এই গতিহীনতা ও স্থবিরত্বের অবশ্যম্ভাবী ফল জাতির পণ্ডিতরা তাদের জীবন ব্যবস্থা দীনের আদেশ নিষেধ গুলির চুলচেরা সুক্ষ বিশ্লেষণ কোরে নানা রকম মাযহাব ও ফেরকা সৃষ্টি করার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং বিকৃত ভারসাম্যহীন সুফীরা আত্মা ঘষামাজার নানা পন্থা তরিকা সৃষ্টি করার সুযোগ ও সময় পেয়েছিলেন। শত্রু এও বুঝেছিলো যে, যতদিন তারা তাদের দাস জাতিটাকে ঐ লক্ষ্য ভুলিয়ে রাখতে পারবে, যতদিন এই জাতি তাদের দীনের ব্যবহারিক দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি নিয়ম কানুনের মসলা মাসায়েল পালন নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, যতদিন তারা তাদের আত্মা পরিষ্কার, ধোয়া মোছায় ব্যাপৃত থাকবে ততদিন তাদের কোন ভয় নাই। কিন্তু একবার যদি এই জাতি কোনও ভাবে আল্লাহ ও তাদের নেতা (সা:) যে লক্ষ্য, যে দিক-নির্দেশনা হেদায়াত তাদের দিয়েছেন তা ফিরে পায় তবে ঠিক আগের মতই তারা আবার এই জাতির সামনে শুকনো পাতার মত উড়ে যাবে এবং তাদের প্রকৃত লক্ষ্যকে যদি তাদের সামনে থেকে আড়াল কোরে রাখতে হয় তবে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ কোরতে হবে।

বুদ্ধিমান শত্রুরা ঠিক এই পদক্ষেপই নিলো। নিদারুণ পরিহাস এই যে, ইউরোপীয়ান বিজয়ী জাতি গুলি এই দাস জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা অধ্যয়ন ও পরীক্ষা কোরে দেখতে পেলো যে, এই জাতিটিকে দাসত্বের শিকলে চিরদিন আবদ্ধ কোরে রাখার জন্য যে রকমের শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরী ও প্রচলন করা দরকার তা কোরতে তাদের খুব বেশী পরিশ্রম কোরতে হবে না। কারণ এই জাতির ফূকাহা, মুফাস্সির, মোহাদ্দিস ও মুফতি এক কথায় পণ্ডিতরা ইতিপূর্বেই সে জন্য অতি সুন্দর ক্ষেত্র প্রস্তুত কোরে রেখেছেন। তারা জাতির একটি অংশকে যা শেখাচ্ছিলেন তাতে জাতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে কিছু নেই, যা আছে তা ভুল। এবং প্রচুর পরিমাণে আছে ছোটখাটো খুঁটিনাটির অবিশ্বাস্য চুলচেরা বিশ্লেষণ, তাই নিয়ে বহুবিধ মতভেদ ও ঝগড়া। এই অধ্যয়নের ফলে তারা এটাও বুঝতে পারলো কেন এই জাতিটি জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে পৃথিবীর শিক্ষকের আসন থেকে এতো অল্প সময়ের মধ্যে একটি অশিক্ষিত মুর্খ জাতিতে পর্যবসিত হোয়েছে। তারা আরও দেখলো যে, ঐ বিশ্লেষণকারী পণ্ডিতদের এবং সুফীদের শিক্ষার ফলে এই জাতির যে সামরিক শিক্ষা ও প্রেরণা ছিলো তা সম্পূর্ণভাবে চাপা পড়ে গেছে বা একেবারে বাদ পড়ে গেছে। সুতরাং ইউরোপীয়ান প্রভুরা এই দাস জাতির পণ্ডিতদের প্রস্তুত ক্ষেত্রের উপরই এক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুললো- এই শিক্ষায় জাতিটি আগের চেয়েও বেশী চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যাপৃত হয়, আরও ফেরকায় বিভক্ত হোয়ে মারামারি করে, আরও অন্তর্মুখী হয় এবং প্রভুরা আরও নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত হোয়ে প্রভুত্ব ও শোষণ কোরতে পারে। এই সময়ের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ কোরলে মনে হয় বিভিন্ন ইউরোপীয়ান শক্তিগুলি একত্রে মিলিত হোয়ে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। কারণ মরক্কো থেকে বোর্নিও পর্য্যন্ত প্রায় সম্পূর্ণ “মুসলিম” জগত অধিকার কোরেছিলো ইউরোপের ছোট বড় বিভিন্ন জাতি গুলি এবং সকলেই একই রকমের পদক্ষেপ
নিয়েছিলো। সেটা হলো এই যে, প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ গোলাম জাতির মধ্যে দু’রকম শিক্ষা পদ্ধতি চালু করলো। একটা হলো তাদের নিজেদের যার যার দেশে প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি। এটা চালু কোরতে তারা খানিকটা বাধ্যও হলো। কারণ তারা যে বিরাট ভূভাগ ও জনসংখ্যা অধিকার কোরেছিলো তা ভালভাবে শাসন কোরতে যে পরিমাণ মানুষ দরকার তাদের দেশ গুলি থেকে অত মানুষ আনা কার্যত সম্ভব ছিলো না, দেশীয় লোকজনের সাহায্য অপরিহার্য ছিলো। তাছাড়া তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হোলে দেশে তাদের অনুগত একটি শ্রেণী সৃষ্টি হবে এ উদ্দেশ্যও ছিলো। তবে ঐ শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা ব্যাপারে বিদেশী প্রভূরা সর্বত্র সতর্ক থেকেছে যে, তাদের নিজেদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় যে নিজের জাতির প্রতি ভালবাসা, আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা গড়ে ওঠে এদের বেলায় যেন তা না হয় বরং তারা যেন নিজেদের পরিচয় না পায়। তাদের অতীত ও বর্ত্তমান সম্বন্ধে যেন অবজ্ঞা ও ঘৃণা সৃষ্টি হয় এবং প্রভুদের সম্বন্ধে যেন তারা হীনমন্যতায় ডুবে থাকে। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় তারা পাঠ্যবস্তু পাঠ্যক্রম (Curriculum) এমনভাবে তৈরী করলো যাতে এই জাতির ইতিহাসের বদলে ইউরোপের বিভিন্ন জাতি গুলির ইতিহাস স্থান পেলো। বিজ্ঞানের যে ভিত্তি মুসলিম জাতি স্থাপন কোরেছিলো, যে ভিত্তির উপর পরে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন জাতি গুলি যে উন্নতি কোরেছিলো তা লুপ্ত কোরে দিয়ে, মুসলিম আবিষ্কারকদের নাম বাদ দিয়ে নিজেদের নাম বসিয়ে তারা শিক্ষার্থীদেরের মনে বিশ্বাস জন্মিয়ে দিলো যে, জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রবর্ত্তক, প্রচলক শুধু তারাই। প্রাচ্যের জাতি গুলির ধর্ম, বিশ্বাস, কুসংস্কার, মানুষ গুলি পশু পর্য্যায়ের। সামরিক দিক দিয়ে তারা এই দাস জাতির ছাত্র-ছাত্রীদের শেখালো যে, হ্যানিবল, সিজার আর নেপোলিয়নের মত বিজয়ী সেনাপতি ইতিহাসে আর হয় নি। ছাত্র-ছাত্রীরাও তাই শিখলো ও বিশ্বাস করলো। তারা জানলো না যে পৃথিবীর ইতিহাসে চির অপরাজিত অর্থাৎ জীবনে কোন যুদ্ধেই হারেন নি এমন সেনাপতি হোয়ে গেছেন মাত্র পাঁচ জন, এবং এই পাঁচজনই প্রাচ্যের। এই পাঁচ জন হোচ্ছেন শেষ নবী মোহাম্মদ (সা:) বিন আব্দুল্লাহ, আল্লাহর তলোয়ার খালেদ বিন ওয়ালিদ (রা:), স্পেনের খলিফা আবদুর রহমান, সুলতান মাহমুদ এবং চেঙ্গিস খান। এবং এই পাঁচ জনের মধ্যে চারজনই মুসলিম। পাশ্চাত্যের কিছু কিছু ইতিহাসবিদ ওহোদের যুদ্ধে বিশ্বনবীকে (সা:) পরাজিত বোলে দেখাতে চেষ্টা কোরেছেন তাদের চিরাচরিত অভ্যাস মোতাবেক তাঁকে ছোট করার জন্য। কিন্তু ঐ যুদ্ধে তার পরাজয় হয় নি। বিপর্যয় হোয়েছিলো, তিনি গুরুতর আহত হোয়েছিলেন, কিন্তু পরাজিত হন নি। প্রকৃতপক্ষে মুসলিমদের একটা শিক্ষা দেবার জন্যই আল্লাহ ঐ ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। সে শিক্ষা হলো এই যে, নেতার বা সেনাপতির আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন না কোরলে কি হয়। খুব বেশী বোললে ওহোদ যুদ্ধের ফলাফল কে সমান সমান অর্থাৎ অচলাবস্থা (Stalemate) বলা যায়। বদর, ওহোদ বা খন্দক; এর যে কোন একটি যুদ্ধেই যদি মহানবী (সা:) পরাজিত হোতেন তবে ঐখানেই ইসলামের সমাপ্তি ঘোটতো। স্বসৈন্যে আলপস পর্বত অতিক্রম কোরেছিলেন বোলে নিপোলিয়ানকে অসম্ভব সম্ভবকারী মানুষ বোলে শেখানো হলো এবং এই দুর্ভাগ্য জাতির ছেলেমেয়েরা তাই শিখলো এবং বিশ্বাস করলো। তারা জানলোও না যে এর চেয়েও শত গুন অসম্ভব কাজ কোরেছিলেন তাদের জাতিরই একজন। ইস্তাম্বুল জয় করার যুদ্ধে সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদ তার সম্পূর্ণ নৌবহরকে পাহাড়ের উপর দিয়ে টেনে অতিক্রম কোরেছিলেন।

এই শিক্ষা ব্যবস্থায় এই দাস জাতির যুব সম্প্রদায়ের মন মানসিকতায় হীনমন্যতা ঢুকিয়ে দিতে আরেক ব্যবস্থা নেওয়া হলো। সেটা হলো শিক্ষার মাধ্যম করা হলো বিভিন্ন বিজয়ী প্রভুদের ভাষা। একদা অর্দ্ধেক পৃথিবী বিজয়ী এই জাতিটাকে সামরিকভাবে পরাস্ত কোরে তাকে খণ্ড খণ্ড কোরে ভাগ কোরে নিয়ে ইউরোপীয়ান জাতি গুলি যার ভাগে যে ভাগ পড়েছিলো সে ভাগে নিজেদের ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্ত্তন করলো। হীনমন্যতায় আপ্লুত করা ছাড়াও আরেকটি উদ্দেশ্য ছিলো আরবী ভাষা থেকে এদের বিচ্ছিন্ন করা, কারণ গোলামে পরিণত হবার আগে সর্বত্র এই জাতির শিক্ষার মাধ্যম ছিলো আরবী, যার ফলে বহু ভাগে বিভক্ত হোয়ে গেলেও সবারই একটা সাধারণ ভাষা (Lingua Franca) হিসাবে আরবী একটা ঐক্যসূত্র হিসাবে কাজ কোরছিলো। ঐ ঐক্যসুত্র কেটে দেওয়াও ছিলো শিক্ষার মাধ্যম পরিবর্ত্তন করার উদ্দেশ্য। কিন্তু নিজেদের ইউরোপীয়ান ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা কোরলেও প্রভুরা পাঠ্যব্যবস্থা এমনভাবে নির্ধারণ করলো যাতে এরা পাশ্চাত্যের বিদ্যালয় গুলির শিক্ষার্থীদের মত প্রকৃত শিক্ষা না পায়, কিন্তু শুধু প্রভুদের পক্ষ হোয়ে তাদের প্রশাসন চালাতে সাহায্য কোরতে পারে। এটুকু করার জন্য যতটুকু অংক, ভূগোল, বিজ্ঞান ও বিকৃত ইতিহাস শিক্ষা দরকার শুধু ততটুকুই করার ব্যবস্থা রইলো। এক কথায় ঐ শিক্ষায় সৃষ্টি হলো একটা কেরানীকুল, যারা মাঝারি ও নিচু পর্য্যায়ের ঔপনিবেশিক প্রশাসন চালিয়ে যেতে পারে। এই শিক্ষার মাধ্যমে সৃষ্ট ‘শিক্ষিত’ শ্রেণীটাই ইউরোপীয়ান প্রভুদের পক্ষ হোয়ে অতি বিশ্বস্তভাবে প্রশাসন চালিয়েছে। এমন সতর্কতার সাথে এই শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালন করা হলো যে, এক পুরুষেরও কম সময়ে বিভিন্ন অধিকৃত দেশে একটি শ্রেণী সৃষ্টি হলো যারা লেখাপড়া জানে কিন্তু হীনমন্যতায় এমন পর্য্যায়ে নেমে গেছে যে পাশ্চাত্য প্রভুরা লাথি মারলে নিজে কতখানি ব্যথা পেয়েছে সেটা বোধ করার আগে প্রভুর পায়ে আঘাত লাগলো কিনা সেই চিন্তা কোরেছে। এই শ্রেনীটি ইউরোপীয়ান প্রভুদের পক্ষ হোয়ে যার যার দেশে ঔপনেবেশিক শাসনের মধ্য ও নিচু পর্য্যায়ের প্রশাসন চালিয়েছে, কোথাও প্রভুদের বিরুদ্ধে অভ্যূত্থান হোলে তাকে দমন কোরেছে, প্রভুদের আদেশে নিজেদের জাতির লোকের বুকে গুলী চালিয়েছে, তাদের জন্য নিজের জাতির বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি কোরেছে। এই শিক্ষিত শ্রেণীটি চলাফেরায়, কথা বার্ত্তায়, পোশাক পরিচ্ছদে আপ্রাণ চেষ্টা কোরেছে তাদের প্রভুদের অনুকরণের। ঐ শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে এই দাস জাতির মধ্যেই একটা অংশ বিজাতীয় হোয়ে গজালো যাদের মন মগজে দাসত্ব ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।

পাশ্চাত্য প্রভুরা গোলাম জাতি গুলোকে মানাসিকভাবে সত্যিকার বিশ্বস্ত দাস বানানোর পরও নিশ্চিত হলো না। কারণ জাতির অনেক বৃহত্তর অংশ তাদের ঐ শিক্ষার প্রভাবের বাইরে ছিলো। যখন সামরিকভাবে যুদ্ধে পরাজিত কোরে এই বিরাট জাতিটাকে তারা দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ কোরেছিল তখন এই জাতির মধ্যে হাজার হাজার বিদ্যালয়, বহু বিশ্ববিদ্যালয় ও তাতে কোটি কোটি ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা কোরত। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা সেখানে ছিলো না সে কথা বলার অপেক্ষা করে না। কারণ তা থাকলে তো আর তাদের পাশ্চাত্যের দাসে পরিণত হোবার প্রশ্নই আসে না। ইসলামের পণ্ডিতদের কার্যের ফলে ঐ শিক্ষা বহু পূর্বেই এই দীনের আদেশ নিষেধের সুক্ষাতিসুক্ষ বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ হোয়ে গিয়েছিলো এবং ঐ বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে ঐ ক্ষতিকর বিষয় গুলিই শিক্ষা দেয়া হতো, যার ফলে জ্ঞান বিজ্ঞানের সুউচ্চ আসন থেকে জাতি এর আগেই মাটিতে পড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু পাশ্চাত্য প্রভুরা নিশ্চিন্ত হোতে পারলো না। দাস জাতির এই বৃহত্তর অংশ থেকে নিরাপদ হবার জন্য তারা যেসব পদক্ষেপ নিলো তা হোচ্ছে এই
ক) প্রথমে তারা এই জাতির তখন বিদ্যমান বিদ্যালয় গুলি, যেগুলির নাম ছিলো মাদ্রাসা, তা ধ্বংস কোরে দিলো। এই ধ্বংস তারা করলো কয়েকটি উপায়ে, বেছে বেছে কতক গুলি বন্ধ কোরে দিলো, কতক গুলিকে সর্বরকম সাহায্য বন্ধ কোরে দিয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুর মধ্যে ফেলে দিলো। বিভিন্ন
ইউরোপীয়ান জাতি গুলি বিভিন্ন ‘মুসলিম’ দেশ গুলিতে কেমন কোরে তাদের নিজস্ব ধারার শিক্ষা যা আরবীর মাধ্যমে ছিলো তা ধ্বংস কোরে দিয়েছিলো তার বিস্তৃত বিবরণে যেতে চাই না, কারণ বই বহু বড় হোয়ে যাবে। শুধু এইটুকু হোলেই আমাদের চোলবে যে, কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি এই দাঁড়ালো যে, এই জাতির একটি ক্ষুদ্র অংশ পরিবর্ত্তিত হোয়ে কালো এবং বাদামী ইউরোপীয়ানে পরিণত হল আর বাকি বৃহত্তর অংশ মুর্খ ও নিরক্ষর লোকসংখ্যায় পর্যবসিত হলো ।
খ) এতেও নিজেদের নিরাপদ মনে না কোরে পাশ্চাত্য প্রভুরা ঐ বৃহত্তর অংশ থেকেও নিরাপদ হবার জন্য অন্য পদক্ষেপ নিলো। সেটা হলো- সেই আরবী মাধ্যমে নতুন কোরে মাদ্রাসা শিক্ষা চালু করা। কিন্তু তফাৎ এই যে, এই শিক্ষা এমন হওয়া যে, এই জাতি যেন কখনও তার প্রকৃত স্বত্ত্বা খুঁজে না পায়। পেছনে বোলে এসেছি যে, এই কাজ করার জন্য অতি সুন্দর ভিত্তি আমাদের পণ্ডিতরা, ফকীহ ও মুফাস্সিররা তৈরী কোরে রেখেছিলেন। ঐ ভিত্তির উপর পাশ্চাত্য প্রভুদের আরবী শিক্ষিত (Orientalists) পণ্ডিতরা এই নতুন মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠ্যসূচী ও পাঠ্যব্যস্থা নির্ধারণ কোরলেন। কোরলেন অতি সতর্কতার সাথে। অতি সতর্কতার সাথে এই দীনের সামরিক দিকটা বাদ দেয়া হলো, জাতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য মনে পড়তে পারে এমন সব কিছুকে ছেটে ফেলা হলো এবং অতি ছোট খাটো তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় ব্যাপার ও বিষয় দিয়ে নতুন পাঠ্যক্রম (Syllabus and Curriculum) তৈরী করা হলো। বিশেষভাবে স্থান দেয়া হলো অপ্রয়োজনীয় কিন্তু বিতর্কিত বিষয় গুলি। নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাতের, ফারায়েজের, বিবি তালাকের, কাপড়-চোপড়ের, দাড়ী-টুপির অবিশ্বাস্য ও চুল চেরা বিশ্লেষণ ও বিতর্কিত বিষয়ের বিচার। উদ্দেশ্য হলো এই শিক্ষায় শিক্ষিতরা যেন ঐ ছোটখাটো বিষয়বস্তুর মধ্যেই সীমিত থাকে, ওর উর্দ্ধে যেন উঠতে না পারে। ব্যক্তিগত এবাদতের সুক্ষতম প্রক্রিয়াও এ পাঠ্যবস্তু থেকে বাদ গেলো না, কিন্তু জাতীয় ব্যাপারের মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলিকে কোনঠাসা কোরে দেয়া হলো, সম্ভব হলে একেবারে বাদ দেয়া হলো।

এত কিছু কোরেও পাশ্চাত্য প্রভূরা নিশ্চিত হোতে পারলো না। এই জাতির কাছ থেকে তারা কী প্রচণ্ড মার খেয়েছিলো তা তারা ভুলে যায় নি, তাদের ভয়ও যায় নি। তাই অতভাবে এই জাতিটাকে পদানত রাখার বন্দোবস্ত কোরেও নিশ্চিত হোতে পারলো না। এই যে নতুন ব্যবস্থায় মাদ্রাসা শিক্ষা তারা চালু করলো এর পরিচালনার ভারও তারা প্রথম দিকে নিজেদের হাতে রাখলো, শুধু পাঠ্যবস্তু নির্দ্ধারণ কোরে দিয়েই মুসলিমদের হাতে ছেড়ে দিলো না।

মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র তারা এই নীতি অবলম্বন করলো। আলজেরিয়া ও অন্যান্য উপনিবেশে ফ্রান্স, ট্রিপলী, লিবিয়া, ইটালী, মিশর, ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ, ইন্দোনেশীয়া, ইন্দোচীনে ওলন্দাজ (ডাচ) এক কথায় সর্বত্র ইউরোপীয় শক্তি গুলি এই জাতিটাকে অন্ধ কোরে রাখার মোটামুটি একই পদ্ধতি কার্যকর করলো। সব গুলির বিবরণে না যেয়ে শুধু এই দেশের উদাহরণ সত্যান্বেষী মনের জন্য যথেষ্ট হবে মনে করি। এই নতুন ব্যবস্থায় প্রথম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় কোলকাতায়, নাম আলীয়া মাদ্রাসা। প্রতিষ্ঠা করেন (১৭৮০) সনে বড় লাট লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস। এই আলীয়া মাদ্রাসার প্রথম অধ্যক্ষ (Principal) নিযুক্ত হন একজন বৃটিশ খ্রীস্টান, নাম ডঃ এ. স্প্রিঙ্গার এম.এ। তারপর একাদিক্রমে ২৭ জন খ্রীস্টান এই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন কোরেছেন এবং তা কোরেছেন তারা ক্রমাগত ১৪৬ বছর (১৭৮০ থেকে ১৯২৬)। তারাই ছাত্রদের কি শিক্ষা দেওয়া হবে তা নির্দ্ধারণ কোরেছেন ও তা কার্যকর কোরেছেন। ঐ মাদ্রাসা থেকে যত আলেম, ফাজেল, কামেল ইত্যাদি বের হোয়ে জাতির অন্য লোকদের ইসলাম শিখিয়েছেন তারা সবাই ‘ইসলাম’ শিখেছেন খ্রীস্টান শিক্ষকদের কাছ থেকে। খ্রীস্টানরা কী ‘ইসলাম’ শিখেয়েছেন তা অনুমান কোরতে বেগ পেতে হয়না। একটু আগেই তা বোলে এসেছি। কী নিদারুণ পরিহাস। একটা জাতির মধ্যে কতখানি বিকৃতি আসলে খ্রীস্টানদের কাছ থেকে ইসলাম শিখে পাস কোরে বের হোয়ে এসে জোব্বা গায়ে দিয়ে, মাথায় পাগড়ী পড়ে, লম্বা দাড়ী ঝুলিয়ে বাকি অশিক্ষিত জাতির মধ্যে পৌরহিত্য কোরে সসম্মানে বাস করা যায়। এটা শুধু এদেশেই নয় ‘মুসলিম’ বিশ্বের সর্বত্র একই ইতিহাস। যাই হোক, পাশ্চাত্য প্রভুরা এই মাদ্রাসা গুলির পরিচালনার ভার বহু বছর পর্য্যন্ত তাদের নিজেদের হাতেই রাখলো। তারপর যখন তারা নিশ্চিত হলো যে, আরবী ভাষার মাধ্যমে কোর’আন হাদীসের বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি কোরেই শিক্ষা দিয়ে এদের এমন পর্য্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হোয়েছে যে, অপ্রয়োজনীয়, বিতর্কিত মসলা-মাসায়েলের জালে এরা এমনভাবে পেঁচিয়ে গেছে ও বাকি অশিক্ষিত জাতিকে পেঁচিয়ে ফেলেছে যে আর তাদের ওর মধ্য থেকে ছুটবার আশংকা নেই, তখন তারা ঐ মাদ্রাসা পরিচালনার ভার ‘মুসলিম’ দের হাতে ছেড়ে দিলো এবং দিলো ঐ মাদ্রাসা ব্যবস্থায় শিক্ষিতদের হাতেই। কলকাতার আলীয়া মাদ্রাসার মত বহু মাদধাসা খ্রীস্টান প্রভুরা বিরাট ‘মুসলিম’ বিশ্বময় প্রতিষ্ঠা কোরে লক্ষ লক্ষ ‘আলেম, ফাজেল, কামেল, ইত্যাদি তৈরী কোরে সমাজের মধ্যে ছেড়ে দেয়। নিরক্ষর মুর্খ জনসাধারণ তাদের কাছ থেকেই ‘ইসলাম’ শেখে। প্রাথমিক ফকীহ, মুফাস্সিরদের দুর্ভাগ্য ক্রমে দীনুল কাইয়্যেমা ও সিরাতুল মোস্তাকীমের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন কোরতে ব্যর্থ হোয়ে অতি বিশ্লেষনে যেয়ে সর্বনাশ কোরেছিলেন, কিন্তু তারা প্রকৃতপক্ষেই জ্ঞানী ও পণ্ডিত ছিলেন। কিন্তু খ্রীস্টান পণ্ডিতদের তত্ত্বাবধানে থেকে তাদের কাছ থেকে ‘ইসলাম’ শিখে এবার যে আলেম, ফাজেল শ্রেণীটি বের হোয়ে এলো- এরা না ছিলো জ্ঞানী, না ছিলো পণ্ডিত। খ্রীস্টান শিক্ষকরা এদের যে শিক্ষা দিয়েছিলো তাতে জাতীয় জীবনের কিছুমাত্র ছিলো না, ছিলো শুধু ব্যক্তিগত খুঁটিনাটি মসলা মাসায়েল এবং বিশেষ কোরে যে গুলো পূর্ববর্তী মাযহাব ও ফেরকা সৃষ্টির কারণে বহুল বিতর্কিত। খ্রীস্টান শিক্ষকরা সতর্কতার সাথে ঐসব বিতর্কিত মসলা মাসায়েলের মধ্যেই এদের শিক্ষা সীমিত রেখেছিলো এই উদ্দেশ্যে যে, এরা যেন ঐ বিতর্কিত মসলা মাসায়েলের তর্কাতর্কি ও মারামারিতে জীবন কাটিয়ে দেয়, জনসাধারণও যেন ইসলাম বোলতে ব্যক্তিগত জীবনের ঐ খুঁটিনাটি মসলাকেই সম্পূর্ণ ইসলাম মনে করে এবং পাশ্চাত্য প্রভুদের জন্য কোন দুশ্চিন্তার কারণ না হয়।

এই পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন যে তাদের আশাতীত ফল দিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আজ পর্য্যন্ত মুসলিম বিশ্বে যে মাদ্রাসা ব্যবস্থায় শিক্ষা চালু আছে তা ঐ খ্রীস্টান প্রভুদের তৈরী করা, যা থেকে অতি ক্ষুদ্র মন মগজ ও প্রায়ান্ধ দৃষ্টি নিয়ে এক পুরোহিত শ্রেণী বের হোয়ে আসছে, যারা স্বল্প বেতনে মসজিদের এমাম, মোয়াজ্জিন হওয়া, মুরদা দাফন করা, মিলাদ পড়ানো ছাড়া জাতীয় আর কোন কাজের উপযুক্ত নয় এটাও প্রভুদের পরিকল্পনা মোতাবেকই। কারণ ঐ মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তারা অন্য কোন এমন শিক্ষা (Vocational) অন্তুর্ভূক্ত করে নি, যাতে এরা উপার্জন কোরে খেতে পারে। উদ্দেশ্য হলো এরা যেন পুরোপুরি পুরোহিত শ্রেণীতে পরিণত হয় এবং ফলে জনসাধারণ আরও বেশী ঐ বিকৃত ব্যক্তিগত বিতর্কিত মাসলা মাসায়েল শিখে তা নিয়ে ব্যাপৃত থাকে ও শাসকরা আরও নিশ্চিন্ত হতে পারে।

কয়েক শতাব্দী ধোরে ইউরোপীয়ান শক্তিগুলি এই তথাকথিত মুসলিম জগতের খণ্ড খণ্ড অংশ গুলি শাসন ও শোষণ করার পর সময় এলো এদের চলে যাবার। মোটামুটি এই শতাব্দীর মাঝামাঝি ঐ খণ্ড খণ্ড অংশ গুলিকে স্বাধীনতা দিয়ে ইউরোপীয়ান শক্তি গুলি প্রাচ্য থেকে চলে গেলো। এই চলে যাবার কারণ প্রধানত এই নয় যে, এই দাস জাতি তার দৃষ্টি ফিরে পেয়েছে, সে আবার নিজেকে চিনতে পেরেছে এবং নিজের হারানো স্থান ফিরে পেতে বিদ্রোহ কোরেছে। অবশ্য বিদ্রোহ দু এক জায়গায় যে হয় নি তা নয়, হোয়েছে কিন্তু তা ভৌগোলিক স্বাধীনতার জন্য। আসল কারণ হলো ইউরোপীয়ান রাষ্ট্রগুলি নিজেদের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কোরে এমন ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্বল হোয়ে গিয়েছিলো যে, তাদের আর এশিয়া আফ্রিকাময় বিরাট উপনিবেশ গুলিকে ধোরে রাখার মত শক্তি ছিলো না। কিন্তু ইচ্ছা কোরলে তারা ঐ দুর্বল শক্তি নিয়েও আরও কিছুকাল তাদের অধিকৃত দেশ গুলিকে অধীন রাখতে পারতো। কিন্তু তা কোরতে গেলে তাদের যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন খুব ক্ষতিগ্রস্ত হতো। তাই তারা বুদ্ধিমানের মত ভাল সম্পর্ক বজায় রেখে আলোচনার মাধ্যমে এই পরাধীন দাস জাতি গুলিকে আপাত স্বাধীনতা দিয়ে ইউরোপে ফিরে গেলো।

উপনিবেশ গুলিকে ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেবার পর ইউরোপীয়ান প্রভুরা চিন্তা করলো ক্ষমতা কাদের হাতে ছেড়ে যাবে? অবশ্য সিন্ধান্ত নিতে বেশী কষ্ট হয় নি, কারণ ভবিষ্যতে কোন্ শ্রেণী তাদের দ্বারা প্রভাবিত হবে, তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ কোরবে, এবং তাদের খুশী রাখতে চেষ্টা কোরবে তা অতি পরিষ্কার। কাজেই যাবার সময় তারা ক্ষমতা ছেড়ে গেলো ঐ শ্রেণীটির হাতে, যাদের তারা এতদিন তাদের ভাষার মাধ্যমে, তাদের তৈরী পাঠ্য বিষয়বস্তু শিক্ষা দিয়ে তাদের নিজ জাতির মন মানসিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন কোরে তাদের বিশ্বস্ত দাসে পরিণত কোরেছিলো। অবশ্য অন্য কোন শ্রেণীর হাতে ক্ষমতা দেয়াও যেতোনা, কারণ ইউরোপীয়ান প্রভুদের সৃষ্ট ঐ শিক্ষিত শ্রেণীটির বাইরে ছিলো আর দু’টি মাত্র শ্রেণী। সে দুটির একটি হলো তাদেরই মাদ্রাসায় ‘শিক্ষিত’ পুরোহিত শ্রেণী, অন্যটি নিরক্ষর ও অশিক্ষিত জনসাধারণ। পুরোহিত শ্রেণীটি মাসলা মাসায়েল ছাড়া আর কিছুই জানতো না, রাষ্ট্র পরিচালনা তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিলো, আর নিরক্ষর অশিক্ষিতদের হাতে শাসনভার দেয়ার তো প্রশ্নই ওঠেনা। কাজেই ক্ষমতা হাতে এলো কালো ফরাসী, বাদামী ইংরাজ, হলদে ওলন্দাজদের হাতে। আগেই বোলে এসেছি এরা প্রভুদের শিক্ষার গুণে চামড়ার রং বাদে আর সব দিক দিয়ে ইউরোপীয়ান। নিজেদের ইতিহাস, জীবন ব্যবস্থা (দীন) সভ্যতা কৃষ্টি সব কিছু থেকেই এরা ছিলো বিচ্ছিন্ন- শুধু বিচ্ছিন্ন নয় বিরোধী, বিগত প্রভুদের সম্বন্ধে গভীর হীনমন্যতায় আপ্লুত। ক্ষমতাপ্রাপ্ত এই শ্রেণীর আশা আকাংখার সঙ্গে তাদের নিজ নিজ জাতির আশা আকংখার কোন মিল ছিলো না, এমন কি বহু ক্ষেত্রে ও বিষয়ে ছিলো বিরোধী। আন্দোলন ও সংগ্রামের ফল হিসাবে যে সব দেশে স্বাধীনতা এসেছে সেসব দেশে মুখ্যতঃ জনসাধারণের প্রচেষ্টার ফলেই এসেছে, কিন্তু ক্ষমতা এসেছে ঐ ‘শিক্ষিত’ শ্রেণীটির হাতে।

এই ক্ষমতার হাত পরিবর্ত্তনের অবশ্যম্ভাবী ফল এই হলো যে, নতুন শাসকরা এতদিন পর স্বাধীন হোয়ে তাদের জীবন ব্যবস্থা- যেটাকে বিদেশী প্রভুরা বিসর্জন দিয়েছিলো, সেটাকে আবার জাতীয় জীবনে পুনর্বাসন করলো না। তারা পূর্ব প্রভুদের চালু করা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দণ্ডবিধি এমনকি শিক্ষা ব্যবস্থা পর্য্যন্ত ঠিক যা ছিলো তাই রাখলো এবং তাদের নিজ নিজ জাতির জীবনে চাপালো। এই নতুন শাসক শ্রেণীর কাছে ইউরোপীয়ানদের সৃষ্ট ব্যবস্থার চেয়ে ভাল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইন কানুন সম্ভব ছিলো না। আল্লাহর দেয়া আইন-কানুন তাদের কাছে চৌদ্দশ বছরের পুরানো সুতরাং পরিত্যাজ্য। এই অপরিসীম হীনমন্যতার ফল এই হলো যে, জেলখানার দরজা খুলে দিয়ে পুলিশ চোলে গেলেও কয়েদীরা জেলখানাতেই বাস কোরতে লাগলো এবং জেল পুলিশ তাদের বেত মেরে, চাবুক মেরে, ঘাড় ধোরে যে কাজ কর্ম করাতো তারা নিজেরাই তা রুটিন মাফিক কোরতে থাকলো। শুধু তফাতের মধ্যে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে কিছু লোককে তারা নির্বাচিত করলো চলে যাওয়া পুলিস প্রভুদের স্থান পুরণের জন্য। এই নতুন পুলিস পূর্বতন পুলিসদের মতই বেত মারে, ঘাড় ধোরে তাদের আগের মতই দৈনন্দিন কাজ কর্ম করাতে থাকলো। তারা কয়েদীদের বোঝালো যে, আগের পুলিস চোলে গেছে, আমরা স্বাধীন হোয়েছি, কিন্তু আমরা এখানেই থাকবো এবং যেভাবে এতদিন চোলেছি ওমনিই চোলবো কারণ এটাই ভাল, এর চেয়ে ভাল ব্যবস্থা আর হোতে পারে না। সাধারণ অশিক্ষিত কয়েদীরা অধিকাংশই তাদের কথা বিশ্বাস করলো এই জন্য যে, তারা যখন স্বাধীন ছিলো সে সময়ের কথা তারা ততদিনে ভুলে গেছে। তাদের অতীত ইতিহাস সম্বন্ধে তখন লজ্জাকর অজ্ঞতা। জেলখানার বাইরে যে আল্লাহর উন্মুক্ত দুনিয়া রোয়েছে তা তাদের জানতে দেয়া হয় নি। আমরা এখনও আমাদের পূর্ব প্রভুদের জেলখানাতেই আছি- শুধু শারিরীকভাবে সেই পুলিস নেই- তাদের ওয়ার্ডাররা (Warder) আছে, তারাই এখনও আমাদের নিয়ন্ত্রণ ও শাসন কোরছে। শুধু আশার কথা এই যে, বিদেশী পুলিস থাকতেও ছিলো এবং এখনও কিছু কয়েদী আছে যাদের মন মগজ তারা জয় কোরতে পারে নি, যারা বিচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম, জেহাদ কোরে যাচ্ছে আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা আবার জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা কোরতে। এরা সংখ্যায় অল্প, বিচ্ছিন্ন তবু এরা মানসিকভাবে ঐ ওয়ার্ডারদের চাপানো খ্রীস্টান প্রভুদের তৈরী আইন-কানুন মেনে নেয়নি। এই নতুন স্বাধীন কিন্তু সেই জেলখানায় বসবাসকারী জাতি গুলির মধ্যে ওয়ার্ডারদের শ্রেণীর কয়েদীরা ছাড়াও লম্বা কুর্ত্তাপরা পাগড়ীধারী কয়েদীরাও বহুসংখ্যক আছে, আর আছে বিরাট সংখ্যায় অজ্ঞ অশিক্ষিত প্রায় পশু পর্য্যায়ের কয়েদীরা। স্বাধীন হবার পর বিদেশী প্রভুদের ট্রেনিং প্রাপ্ত শিক্ষিত শ্রেণীটি যখন ক্ষমতা হাতে পেয়ে প্রভুদের তৈরী আইন-কানুন ইত্যাদি সব কিছু সমগ্রভাবে (Lock, Stock and Barrel) কয়েদীদের উপর চাপালো তখন ঐ লম্বা কোর্ত্তা, পাগড়ীধারী শ্রেণীটি যেটি নিজেদের অতি উৎকৃষ্ট মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদী বোলে বিশ্বাস করে সেটিও বিচ্ছিন্ন ও মৃদু প্রতিবাদের বেশী কিছুই করলো না। কারণ তারাও তাদের ইসলাম শিখেছিলো সেই বিদেশী প্রভুদের কাছ থেকেই, যে ইসলামে ব্যক্তিগত দৈনন্দিন জীবনের মাসলা মাসায়েল ছাড়া আর কিছুই নেই। তাদের ইসলামে একথা বলে না যে জাতীয় জীবনে আল্লাহর দেয়া আইন-কানুন ও দণ্ডবিধিকে বাদ দিয়ে অন্য কোন আইন-কানুন ও দণ্ডবিধি গ্রহণ কোরলে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকেই অস্বীকার করা- যা সরাসরি শেরক ও কুফর। তাছাড়া ঐ বহু প্রকারের মাযহাব ফেরকায় বিভক্তির জন্য তারা ঐক্যবদ্ধ হোয়ে দাঁড়িয়ে তাদের নিজস্ব জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা করার দাবীও কোরতে পারে নি। ঐ দাবী কোরে আসছে ঐ অল্প সংখ্যক লোক, যাদের মন মগজ বিদেশী প্রভুরা ও পরে যাদের হাতে প্রভুরা ক্ষমতা ছেড়ে গেলো তারা জয় কোরতে পারে নি। কিন্তু তারা এখনও পর্য্যন্ত কৃতকার্য হোতে পারে নি। পারে নি তার কতক গুলি কারণ আছে। সংখ্যা স্বল্পতা ছাড়াও তারা এখনও বিচ্ছিন্ন এবং ইসলাম কী সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি- যাকে বলা হয় আকীদা, সেই আকীদার অভাব এবং ক্ষমতাসীন ওয়ার্ডারদের বিরোধীতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিভিন্ন জেলখানায় অর্থাৎ বিভিন্ন দেশে ঐ ছোট্ট ছোট্ট দল গুলির আওয়াজ ক্রমশঃ উচ্চ হোচ্ছে এবং মরক্কো থেকে ফিলিপাইন পর্য্যন্ত এই বিরাট এলাকার প্রতি দেশে একটা ক্রন্দন অনুভূত হোচ্ছে, যেটা বিগত বিদেশী প্রভুদের এবং তাদের প্রতিভূ দেশী ওয়ার্ডারদের শংকিত কোরে তুলছে।

Leave a Reply