You are currently viewing মুমিন মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদী
মুমিন মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদী

মুমিন মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদী

মুমিন মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদী

বর্ত্তমান সময়ে চালু ইসলামে ‘মুমিন’, ‘মুসলিম’ ও ‘উম্মতে মোহাম্মদী’এই তিনটিকে একার্থবোধক অর্থাৎ তিনটিই একই জিনিস হিসাবে নেওয়া হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। তিনটিই আলাদা, যদিও পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। আকীদা সঠিক করার জন্য এই তফাৎ বুঝে নেওয়া দরকার।

প্রথমতঃ মুমিন শব্দটা এসেছে ঈমান অর্থাৎ বিশ্বাস থেকে। যে বা যারা আল্লাহ্, রসুল, কোরআন, মালায়েক (ফেরেশতা) শেষ বিচার, জান্নাত, জাহান্নাম, এক কথায় আল্লাহ কোরআনে যা বোলেছেন এবং রসুল (দ:) হাদীসে যা বোলেছেন তা সব নিঃসন্দেহে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করেন, সেসব লোক মুমিন। কিন্তু মুমিন হওয়া মানেই মুসলিম হওয়া নয়। কারণ কোন লোক সব কিছু বিশ্বাস কোরেও, সত্য জেনেও আল্লাহর দেওয়া জীবন ব্যবস্থাকে জাতীয়, সামাজিক জীবনে প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা নাও কোরতে পারেন। বিশ্বাস কোরেও প্রয়োগ না করার কারণ অনেক কিছু হোতে পারে। যেমন-বিকৃত আকীদা, হীনমন্যতা, পাশ্চাত্য জগত সেকেলে ভাববে-আধুনিক জগতে এটার আইন অচল ইত্যাদি ধারণা (আকীদা)। এই সব লোক ব্যক্তিগতভাবে মুমিন হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম নন, উম্মতে মোহাম্মদীও নন। আল্লাহ ধোরে নিচ্ছেন যে- যে আমাকে ও আমার কথা বিশ্বাসই করলো সে স্বভাবতই পৃথিবীর অন্য সমস্ত কিছু অস্বীকার কোরে আমার দেওয়া দীন তার পূর্ণ জীবনে প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা কোরবে। কাজেই তিনি কোরআনে বহু জায়গায় মুমিনদের ক্ষমা, দয়া ও জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু হীনমন্যতায় বা আকীদা বিকৃতির জন্য যারা ‘দীন’ জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা কোরবে না তাদের তিনি ঈমান থাকা সত্ত্বেও মুমিন বোলে স্বীকার কোরবেন না। তারা মুসলিমও নয়, উম্মতে মোহম্মদী তো নয়ই। উদাহরণ বর্ত্তমানে ‘মুসলিম’ বোলে পরিচিত জনসংখ্যাটি।

দ্বিতীয়তঃ মুসলিম শব্দ এসেছে সালাম থেকে। যিনি বা যারা আল্লাহর দেওয়া জীবন ব্যবস্থা, দীনকে সামগ্রীকভাবে তসলিম অর্থাৎ সসম্মানে গ্রহণ কোরে তা জাতীয়, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা কোরেছেন, অন্যসব রকম ব্যবস্থাকে বর্জন কোরেছেন তিনি বা তারা মুসলিম। এখানেও একজন মুসলিম হোয়েও মুমিন নাও হতে পারেন। যেমন- কোথাও দেশসুদ্ধ সকলে মুসলিম হোয়ে গেলো। সেখানে একজন বা কিছুসংখ্যক মুশরিক বা নাস্তিক নানা রকম সামাজিক অসুবিধার কথা চিন্তা কোরে মুসলিম হোয়ে গেলো, অর্থাৎ আল্লাহ, রসুল (দ:) ও ইসলামকে পূর্ণভাবে বিশ্বাস না কোরেও সমাজের অন্য সবার সাথে আল্লাহর আইন ও দীন স্বীকার ও তসলিম কোরে নিলো। এ লোক মুসলিম, কিন্তু মুমিন নয়। এর উদাহরণ দেওয়া যায় ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই। নবী করীমের (দ:) ওফাতের আগেই সম্পূর্ণ আবর মুসলিম হোয়ে গিয়েছিলো এটা ইতিহাস। কিন্তু আল্লাহ নবীকে (দ:) সম্বোধন কোরে বোলেছেন-“আরবরা বলে, আমরা বিশ্বাস কোরেছি (ঈমান এনেছি)। বল, তোমরা বিশ্বাস করনি। বরং বল, আমরা শুধু আত্মসমর্পণ কোরেছি। কারণ বিশ্বাস (ঈমান) তোমাদের আত্মায় প্রবেশ করে নি।” এর ঠিক পরের আয়াতেই আল্লাহ প্রকৃত মুমিন কে, তা আমাদের বোলে দিচ্ছেন। আল্লাহ বোলেছেন-“শুধু তারাই মুমিন যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে বিশ্বাস করে, তারপর আর (সে সম্বন্ধে) কোন সন্দেহ পোষণ করে না এবং তাদের সম্পদ (টাকা-পয়সা ও সম্পত্তি) ও প্রাণ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করে। (শুধু) এরাই হলো অকপট সত্য ।

আরাব মরুবাসীরা বলেঃ আমরা ঈমান আনলাম। তুমি বলঃ তোমরা ঈমান আননি, বরং তোমরা বলঃ আমরা আত্মসমর্পন করেছি; কারণ ঈমান এখনো তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি। যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর তাহলে তোমাদের কর্মফল সামান্য পরিমানও কম করা হবেনা। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। তারাই মু’মিন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করেনা এবং জীবন ও সম্পদ দ্বারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে, তারাই সত্যনিষ্ঠ। -সুরা হুজরাত-১৪-১৫

অর্থাৎ মুমিন হোতে হোলে এবং আকীদা যদি বিকৃত না হয় তবে অবশ্য অবশ্যই জানমাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ কোরতে হবে। যে কথাটা আমার এই সমস্ত বইটায় বোলতে চেষ্টা কোরেছি। আল্লাহর কথা যে সত্য তা প্রমাণ হোয়ে গেলো রসুলাল্লাহ (দ:) এর ওফাতের সঙ্গে সঙ্গেই। চারদিকে বহু লোক ইসলামকে অস্বীকার কোরে বিদ্রোহী হোয়ে উঠলো। অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষ ইসলামকে গ্রহণ করার ফলে তারা বাধ্য হোয়ে প্রকাশ্যে ইসলামকে স্বীকার কোরে মুসলিম হোয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু সত্যিকার বিশ্বাস তারা করে নি, তারা মুসলিম হোয়েছিলো, কিন্তু মুমিন হয় নি।

মুমিন ও মুসলিম যে এক নয় তা হাদীস থেকেও দেখাচ্ছি। সাদ (রা:) বোলছেন- একবার আমি রসুলাল্লাহর (দ:) কাছে বসা ছিলাম- যখন তিনি একদল লোককে দান কোরছিলেন। সেখানে এমন একজন লোক বসা ছিলেন যাকে আমি একজন উত্তম মুমিন বোলে বিশ্বাস কোরতাম। কিন্তু তিনি (নবী করিম দঃ) তাঁকে কিছুই দিলেন না। এ দেখে আমি বোললাম ইয়া রসুলাল্লাহর (দ:) আপনি ওনাকে কিছু দিলেন না? আমার দৃঢ় বিশ্বাস উনি একজন মুমিন। রসুলাল্লাহ (দ:) বোললেন মুমিন বোলো না মুসলিম বলো। আমি কিছু সময় চুপ থেকে আবার ঐ কথা বোললাম এবং তিনিও আবার ঐ জবাবই দিলেন-মুমিন বোলো না মুসলিম বলো। তৃতীয়বার আমি ঐ কথা বোললে রসুলাল্লাহ (দ:) বোললেন সাদ! আমি অপছন্দনীয় লোকদেরও দান করি, এই কারণে যে আমার আশংকা হয় তারা অভাবের চাপে জাহান্নামের পথে চলে যেতে পারে।”– সহি আল বুখারী- ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ২৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ২৭ এখানে মহানবীর (দ:) কথা থেকেই পরিষ্কার হোয়ে যাচ্ছে যে মুমিন ও মুসলিম এক নয়।

এই হাদীসের আরেকটি চিত্তাকর্ষক দিক আছে। সাদ (রা:) যার জন্য সুপারিশ কোরছিলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি যোয়াইল (রা:) যার সম্বন্ধে মহানবী (দ:) স্বয়ং বিভিন্ন সময়ে প্রশংসা কোরেছেন। অর্থাৎ সাদ (রা:) ঠিকই বোলেছিলেন যে তিনি উত্তম মুমিন। আসল কথা, বিশ্বনবী (দ:) সেদিন দান কোরছিলেন মুসলিমদের-মুমিনদের নয়, তাই তিনি সেদিনের দানে যোয়াইল (রা:) কে অন্তর্ভুক্ত করেন নি এবং সাদ (রা:) যখন তাকেও দান কোরতে অনুরোধ কোরলেন তখন তিনি (দ:) সাদ (রা:) কে বোললেন মুমিন বোলো না, মুসলিম বলো। অর্থাৎ আজকের দান নিতে হোলে যোয়াইল (রা:) কে মুসলিম হিসাবে নিতে হবে। এ ছাড়াও আল্লাহ বহু জায়গায় মুমিনদের এবং মুসলিমদের আলাদা আলাদা ভাবে সম্বোধন কোরেছেন।

তৃতীয়তঃ উম্মতে মোহাম্মদী। এ সম্বন্ধে পেছনে বোলে এসেছি। আল্লাহ আদম (আ:) থেকে শুরু কোরে তার প্রত্যেক নবী-রসুল (আ:) কে পাঠিয়েছেন একটিমাত্র উদ্দেশ্য দিয়ে, তাহলো যার যার জাতির মধ্যে আল্লাহর তওহীদ ও তার দেওয়া জীবন ব্যবস্থা দীন প্রতিষ্ঠা করা। শেষ নবীকে (দ:) পাঠালেন সমস্ত মানব জাতির উপর এই দীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য, এই বিষয়ে আল্লাহ ঘোষনা:
তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি এটাকে সকল দীনের উপর বিজয়ী করতে পারেন। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।- সুরা আল-ফাতাহ-২৮
তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দীন সহ প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি একে সকল দীনের উপর বিজয়ী করেন, যদিও মুশরিকরা অপছন্দ করে। – সুরা আত-তাওবা-৩৩
তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্যদ্বীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি সকল দ্বীনের উপর তা বিজয়ী করে দেন। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।- সুরা আস-সফ-৯

পূর্ববর্ত্তী নবীদের উপর অর্পিত দায়িত্ব তাঁরা অনেকেই তাদের জীবনেই পূর্ণ কোরে যেতে পেরেছিলেন, কারণ তাদের দায়িত্বের পরিসীমা ছিলো ছোট। কিন্তু এই শেষ জনের (দ:) দায়িত্ব হলো এত বিরাট যে এক জীবনে তা পূর্ণ কোরে যাওয়া অসম্ভব। অথচ যতদিন ঐ দায়িত্ব পূর্ণ করা না হবে ততদিন তার উপর আল্লাহর দেওয়া দায়িত্ব অপূর্ণ-অসমাপ্ত থেকে যাবে। তাই তিনি (দ:) এমন একটি জাতি সৃষ্টি কোরলেন পৃথিবী থেকে তাঁর চলে যাওয়ার পরও যে জাতি তার উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ করার জন্য তারই মত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। এই জাতি হলো তার উম্মাহ-উম্মতে মোহাম্মদী- মোহাম্মদের জাতি। বিশ্বনবী (দ:) তার উম্মাহকে পরিষ্কার কোরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তার চলে যাবার পর তিনি যেমন কোরে সংগ্রাম কোরে সমস্ত আরবে দীন প্রতিষ্ঠা কোরলেন, ঠিক তেমনি কোরে বাকি দুনিয়ায় ঐ দীন প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব তাদের উপর অর্পিত হবে। ঐটাকে তিনি বোললেন ‘আমার সুন্নাহ’; অর্থাৎ আমি সারা জীবন যা কোরে গেলাম এবং এও বোললেন যে, যে আমার এই সুন্নাহ ত্যাগ কোরবে সে বা তারা আমার কেউ নয়, অর্থাৎ আমার উম্মত নয়। অবশ্যই, কারণ আল্লাহ যে দায়িত্ব দিয়ে তাকে পৃথিবীতে পাঠালেন, যে দায়িত্ব তিনি এক জীবনে পূর্ণ কোরতে না পারায় এক উম্মাহ সৃষ্টি কোরে তার উপর অর্পন কোরে চোলে গেলেন, সেই দায়িত্ব যে বা যারা ছেড়ে দেবে-ত্যাগ কোরবে, তারা নিশ্চয়ই তার কেউ নয়। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে প্রথম যিনি বিশ্বনবীকে (দ:) প্রেরিত বোলে স্বীকার কোরে এই দীনে প্রবেশ কোরলেন, অর্থাৎ আবু বকর (রা:) মুসলিম হোয়েই রসুলাল্লাহকে (দ:) জিজ্ঞাসা কোরলেন- “হে আল্লাহর রসুল! এখন আমার কাজ কি? কর্ত্তব্য কি?” আল্লাহর শেষ নবী (দ:) যে উত্তর দিয়েছিলেন তা আমরা ইতিহাসে ও হাদীসে পাই। তিনি বোললেন, “এখন থেকে আমার যে কাজ তোমারও সেই কাজ।” কোন সন্দেহ নেই যে যদি প্রত্যেকটি মানুষ-যারা ঈমান এনে মহানবীর (দ:) হাতে মুসলিম হোয়েছিলেন তারা আবু বকরের (রা:) মত- যদি ঐ প্রশ্ন কোরতেন তবে তিনি (দ:) প্রত্যেককেই ঐ জবাব দিতেন। “আমার যে কাজ” বোলতে তিনি কী বুঝিয়েছিলেন? তাঁর (দ:) কী কাজ ছিলো? তাঁর কাজ তো মাত্র একটা, যে কাজ আল্লাহ তাঁর উপর অর্পণ কোরেছেন। সেটা হলো সমস্ত রকমের জীবনব্যবস্থা ‘দীন’ পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন কোরে দিয়ে এই শেষ দীনকে মানব জীবনে প্রতিষ্ঠা করা। ইতিহাসে পাচ্ছি, শেষ-ইসলামকে গ্রহণ করার দিনটি থেকে শেষ নিঃশ্বাস পর্য্যন্ত আবু বকরের (রা:) কাজ একটাই হোয়ে গিয়েছিলো। সেটা ছিলো মহানবীর (দ:) সংগ্রামে তাঁর সাথে থেকে তাঁকে সাহায্য করা। শুধু আবু বকর নয়, যে বা যারা নবীকে (দ:) বিশ্বাস কোরে মুসলিম হোয়েছেন সেই মুহূর্ত্ত থেকে মৃত্যু পর্য্যন্ত তিনি বা তারা বিশ্বনবীকে (দ:) তাঁর ঐ সংগ্রামে সাহায্য কোরে গেছেন, তাঁর সুন্নাহ পালন কোরে গেছেন। আর কেমন সে সাহায্য! স্ত্রী-পুত্র-পরিবার ত্যাগ কোরে, বাড়ী-ঘর, সম্পত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য ত্যাগ কোরে, অর্দ্ধাহারে-অনাহারে থেকে, নির্মম অত্যাচার সহ্য কোরে, অভিযানে বের হোয়ে গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে এবং শেষ পর্য্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন বিসর্জন দিয়ে। এই হলো তার উম্মাহ, উম্মতে মোহাম্মদী, তাঁর প্রকৃত সুন্নাহ পালনকারী জাতি।

উম্মতে মোহাম্মদীর যে অর্থ বোললাম, আবু বকর (রা:) সহ সমস্ত সাহাবারা যে সেই অর্থেই বুঝেছিলেন, বিশ্বনবী (দ:) যে সেই অর্থই তাদের বুঝিয়েছিলেন তার অকাট্য প্রমাণ হোচ্ছে রসুলাল্লাহর (দ:) পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পর ৬০/৭০ বৎসর পর্য্যন্ত তাঁর উম্মাহর কার্য্যাবলী। এ ইতিহাস অস্বীকার করার কারো উপায় নেই যে নবী করিমের (দ:) পর তাঁর ঐ উম্মাহ বৃহত্তর ক্ষেত্রে অর্থাৎ আরবের বাইরে তাঁর ঐ সংগ্রাম ছড়িয়ে দিলো এবং পৃথিবীর একটা বিরাট অংশে এই দীন প্রতিষ্ঠা করলো। আমি উম্মতে মোহাম্মদীর যে অর্থ-সংজ্ঞা কোরছি তা যদি ভুল হোয়ে থাকে তবে ঐ উম্মাহর ঐ কাজের আর মাত্র দু’টি অর্থ হোতে পারে। সে দু’টি হোচ্ছে-
ক) অস্ত্রের জোরে পৃথিবীর মানুষকে ধর্মান্তরিত করা। এটা হোয়ে থাকলে আল্লার বাণী- “বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা নিষিদ্ধ” এর অর্থ আল্লাহর নবীও (দ:) বোঝেন নি, তাঁর সাহাবীরাও বোঝেন নি বা অস্বীকার কোরেছেন (নাউযুবিল্লাহ), আর তা হোলে অন্তত ঐ সময়ের জন্য আটলান্টিকের তীর থেকে চীনের সীমান্ত আর উরাল পর্বত থেকে ভারত মহাসাগর এই ভূখণ্ডে একটাও অমুসলিম থাকতো না। কিন্তু ইতিহাস তা নয়।
খ) পররাজ্য, পর-সম্পদ লোভে আলেকজাণ্ডার, তৈমুর, হালাকু ইত্যাদির মত সাম্রাজ্য বিস্তার। যদি তা হোয়ে থাকে তবে মোহাম্মদ (দ:) অবশ্যই আল্লাহর রসুল ছিলেন না (নাউযুবিল্লাহ)।
তৃতীয় এমন কোন কারণ হোতে পারে না যেজন্য একটি দেশের প্রতিটি যুদ্ধক্ষম ব্যক্তি তার পার্থিব সব কিছু কোরবান কোরে বছরের পর বছর একটানা যুদ্ধ কোরে যেতে পারে। রসুলাল্লাহ (দ:) বোলেছেন, “যে বা যারা আমার সুন্নাহ ত্যাগ কোরবে তারা আমাদের কেউ নয়।” যে বা যারা রসুলাল্লাহর কেউ নয় সে বা তারা কি তাঁর উম্মাহ, ‘উম্মতে মোহাম্মদী’? সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়- অবশ্যই নয়। অর্থাৎ তাঁর (দ:) সুন্নাহ ও তাঁর উম্মাহ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটা ছাড়া আরেকটা নেই। আল্লাহ তাঁর নবীর (দ:) উপর যে দায়িত্ব অর্পণ কোরেছিলেন, শুধু দায়িত্ব অর্পণ কোরেছিলেন তাই নয়, যে কাজটা কোরতে তাঁকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন, যে কাজ তিনি দায়িত্ব পাবার মুহূর্ত্ত থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত্ত পর্য্যন্ত কোরে গেলেন- অর্থাৎ সংগ্রাম ও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে এই জীবন ব্যবস্থা, এই শেষ দীন প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা- এটাই হলো তাঁর প্রকৃত সুন্নাহ। এই সুন্নাহ ত্যাগকারীদের সম্বন্ধেই তিনি বোলেছিলেন ‘তারা আমার নয়’। তার ব্যক্তি জীবনের ছোটখাট, কম প্রয়োজনীয় অভ্যাসের সুন্নাহ বোঝান নি। একটা গুরুত্বপূর্ণ হাদীস উল্লেখ কোরছি। তিনি (দ:) বোলেছেন-
“এমন সময় আসবে যখন আমার উম্মাহ প্রতিটি ব্যাপারে বনি ইসরাইলকে নকল কোরবে। এমনকি তারা যদি তাদের মায়ের সাথে প্রকাশ্যে ব্যভিচার করে তবে আমার উম্মাহ থেকেও তাই করা হবে। বনি ইসরাইলরা বাহাত্তর ফেরকায় (ভাগে) বিভক্ত হোয়েছিল, আমার উম্মাহ তিয়াত্তর ফেরকায় বিভক্ত হবে। এর একটি ভাগ ছাড়া বাকি সবই আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে।” সাহাবারা প্রশ্ন কোরলেন-“ইয়া রসুলাল্লাহ! সেই এক ফেরকা কোনটি?” তিনি (দ:) জবাব দিলেন-“যার উপর আমি ও আমার সঙ্গীরা (আসহাব) আছি”- আবদুল্লাহ বিন আমর (রা:) থেকে- তিরমিযি, মেশকাত।
এই হাদীসটির কয়েকটি অংশ আছে। আমরা একটা একটা কোরে বুঝে নিতে চেষ্টা করবো।
প্রথমতঃ– প্রথমেই যে তিনি ‘আমার উম্মাহ’ বোলে শুরু কোরলেন তাতে তিনি তাঁর প্রকৃত উম্মাহ বোঝান নি। পেছনে যেমন বোলে এসেছি অন্য জাতি গুলি থেকে আলাদা কোরে বোঝাবার জন্য অর্থাৎ In genaral sense।
দ্বিতীয়তঃ বনি ইসরাইল বোলতে তিনি বর্ত্তমানে ইহুদী-খ্রীস্টান (Judio-Christian Civilisation) সভ্যতা বুঝিয়েছেন। ‘পাশ্চাত্য সভ্যতা’ শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে খ্রীস্টান ইউরোপ ও আমেরিকার কথাই মনে আসে। কিন্তু আসলে এরা গোড়া ইহুদী। ঈসা (আ:) খাঁটি ইহুদী বংশে জন্মেছিলেন, নিজে ইহুদী ছিলেন, তাঁর প্রত্যেকটি শিষ্য ইহুদী ছিলেন, ইহুদীদের বাইরে তাঁর শিক্ষা প্রচার করা তাঁরই নিষেধ ছিলো। অর্থাৎ মুসার (আ:) দীনকে তাঁর ধর্মের আলেম-যাজকরা বিকৃত, ভারসাম্যহীন কোরে ফেলায় সেটাকে আবার ভারসাম্যে ফিরিয়ে আনাই ছিল তাঁর কাজ, নতুন কোন ধর্ম সৃষ্টি করা নয়। কিন্তু সেটাকে কেমন কোরে একটা নতুন ধর্মের রূপ দেওয়া হোয়েছিলো তা পেছনে বোলে এসেছি। কাজেই বিশ্বনবী (দ:) এখানে আলাদা কোরে খ্রীস্টান না বোলে একেবারে গোড়ায় ধোরে শুধু ইহুদী বোলছেন, কিন্তু বোঝাচ্ছেন আজকের এই জুডিও খ্রীস্টান সভ্যতা। তিনি বোলছেন আমার উম্মাহ ঐ ইহুদী-খ্রীস্টান অর্থাৎ বর্ত্তমানের পাশ্চাত্য সভ্যতাকে নকল-অনুকরণ কোরতে কোরতে হীনমন্যতার এক বীভৎস পর্য্যায় পর্য্যন্ত যাবে। আজ নিজের জাতিটির দিকে চেয়ে দেখুন- যেটাকে সবাই বিনা দ্বিধায় উম্মতে মোহাম্মদী বোলে বিশ্বাস করে- এ জাতির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শিক্ষা, আইন-দণ্ডবিধি ইত্যাদি প্রত্যেকটি জিনিস ঐ ইহুদী-খ্রীস্টানদের নকল-অনুকরণ। এ সমস্ত ব্যাপার থেকে আল্লাহর দীন ও তাঁর আদেশ সম্পুর্ণভাবে বাদ দেয়া হোয়েছে। যে উম্মাহটাকে সৃষ্টিই করা হোয়েছে ঐ গুলি নিষক্রীয়-অকেজো কোরে দিয়ে বিশ্বনবীর (দ:) মাধ্যমে দেওয়া দীনকে পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা করার জন্য, সেই উম্মাহই যদি নিজেরটা ত্যাগ কোরে ঐ গুলিই গ্রহণ ও নিজেদের উপর প্রতিষ্ঠা করে তবে সেই উম্মাহকে ‘উম্মতে মোহাম্মদী’ বলার চেয়ে হাস্যকর ও অসত্য আর কী হোতে পারে?

তৃতীয়তঃ কথা হলো রসুলাল্লাহ (দ:) বোলেছেন- বনি ইসরাইল বাহাত্তর ফেরকায় বিভক্ত হোয়ে গিয়েছিলো, আমার উম্মাহ তিয়াত্তর ফেরকায় বিভক্ত হবে এবং মাত্র একটি ফেরকা (যেটা জান্নাতী) বাদে সব গুলি ফেরকাই আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে। অতি স্বাভাবিক কথা। কারণ যে ঐক্য ছাড়া পৃথিবীতে কোন কাজই করা সম্ভব নয়, কাজেই যে ঐক্যকে অটুট রাখার জন্য আল্লাহ সরাসরি হুকুম কোরলেন-“আমার দেওয়া দীন সকলে একত্রে ধোরে রাখো এবং নিজেরা বিচ্ছিন্ন হোয়োনা”-সুরা আল-ইমরান-১০৩ যে ঐক্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মহানবী (দ:) বোললেন, “কোর’আনের কোন আয়াতের অর্থ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক কুফর”-হাদিস আব্দুল্লাহ বিন আমর থেকে মুসলিম মেশকাত যে ঐক্য ও শৃঙ্খলা সুদৃঢ় করার জন্য বোললেন-“কান কাটা নিগ্রো ক্রীতদাসও যদি তোমাদের নেতা হয় তাহোলেও ঐক্যবদ্ধভাবে তার আদেশ নির্দেশ পালন কর”-হাদীস- ইরবাদ বিন সারিয়াহ (রা:) থেকে আহমদ, আবু দাউদ তিরমিযি এবং ইবনে মাজাহ, মেশকাত (এই ঐক্য অটুট রাখার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দ:) কতভাবে চেষ্টা কোরেছেন তা কোরআন এবং হাদীস থেকে দেখাতে গেলে আলাদা বই হোয়ে যাবে।) সেই ঐক্যকে যারা ভেঙ্গে তিয়াত্তর ফেরকায় বিভক্ত হোয়ে যাবে-তারা আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে না তো কোথায় নিক্ষিপ্ত হবে? জান্নাতে?

চতুর্থতঃ কথা হলো যে একটি মাত্র ফেরকা (ভাগ) জান্নাতী হবে- যেটার কথা রসুলাল্লাহ (দ:) বোলেছেন- সেটা সেই কাজ নিয়ে থাকবে যে কাজের উপর তিনি ও তাঁর আসহাব ছিলেন। তিনি (দ:) ও তাঁর আসহাব (রা:) কিসের উপর- কোন কাজের উপর ছিলেন? সেই মহাজীবনী যারা পড়েছেন, তাঁর (দ:) সাহাবাদের ইতিহাস যারা পড়েছেন-তাদের এ কথা স্বীকার করা ছাড়া কোন পথ নেই যে, নবুয়ত পাওয়ার সময় থেকে শেষ নিঃশ্বাস পর্য্যন্ত এই অতুলনীয় মানুষটির একটিমাত্র কাজ ছিলো। সেটা হলো এই শেষ জীবনব্যবস্থা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা কোরে মানুষের জীবনে ন্যায়-শান্তি আনা এবং তার জীবিত অবস্থায় ও তাঁর ওফাতের পরে তাঁর সঙ্গীদেরও (আসহাব) জীবন ঐ একই কাজে ব্যয় হোয়েছে। অর্থাৎ নেতা ও তার জাতির সম্পূর্ণ জীবন কেটেছে মানব জাতির কল্যানের জন্য। যে কল্যাণের একটিমাত্র পথ-মানবের জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহর দেওয়া জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা, এক কথায় আল্লাহকে দেওয়া ইবলিসের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় আল্লাহকে জয়ী কোরে সমস্ত মানব জাতিকে অন্যায়-অবিচার-অশান্তি-যুদ্ধ ও রক্তপাত থেকে উদ্ধার কোরে পরিপূর্ণ শান্তি, ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। যে বা যারা এই সংগ্রাম কোরবে শুধু তারাই রসুলাল্লাহর (দ:) সুন্নাহ পালনকারী, অর্থাৎ যার উপর আল্লাহর রসুল (দ:) ও তার আসহাব (রা:) ছিলেন। ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য কোরলে দেখা যাবে বিশ্বনবীর (দ:) ঐ সঙ্গীরা (আসহাব) তাঁর ওফাতের পর তাদের নেতার উপর আল্লাহর অর্পিত কাজ একাগ্রচিত্তে চালিয়ে গেলেন, পার্থিব সমস্ত কিছু উৎসর্গ কোরে চালিয়ে গেলেন। কারণ তাদের কাছে ঐ কাজ ছিলো বিশ্বনবীর (দ:) সুন্নাহ। ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য কোরলে আরও দেখা যায় যে, বিশ্বনবীর (দ:) সংসর্গ যারা লাভ কোরেছিলেন, সরাসরি তাঁর কাছ থেকে এই দীন শিক্ষা কোরেছিলেন, এই দীনের উদ্দেশ্য এবং সেই উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া শিক্ষা কোরেছিলেন তারা তাঁর (দ:) ওফাতের পর ৬০/৭০ বছর পর্য্যন্ত বেঁচেছিলেন এবং ঐ ৬০/৭০ বছর পর বিশ্বনবীর (দ:) সাক্ষাত-সঙ্গীরা (রা:) শেষ হোয়ে যাবার পরই পৃথিবীতে এই দীন প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রাম বন্ধ হোয়ে গিয়েছিলো। এই সংগ্রাম যেই মুহূর্ত্তে বন্ধ হলো জাতি হিসাবে ত্যাগ করা হলো সেই মুহূর্ত্ত থেকে জাতি হিসাবে প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী শেষ হোয়ে গেলো। সেই জন্য মহানবী (দ:) তাঁর সুন্নাহ বোলতে শুধু তাঁর নিজের সুন্নাহ বোললেন না। বোললেন- “আমি ও আমার সঙ্গীরা যার উপর আছি” এবং অন্য সময় এও বোললেন যে “আমার উম্মাহর আয়ু ৬০/৭০ বছর।”

Leave a Reply