You are currently viewing রাসূল (সা:) আগমনের উদ্দেশ্য, তাসাউফ শিক্ষা দেয়া?
রাসূল (সাঃ) আগমনের উদ্দেশ্য তাসাওয়াফ শিক্ষা দেয়া?

রাসূল (সা:) আগমনের উদ্দেশ্য, তাসাউফ শিক্ষা দেয়া?

রাসূল (সা:) আগমনের উদ্দেশ্য, তাসাউফ শিক্ষা দেয়া?

সুফীদের যে উদ্দেশ্য চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক উন্নতি তা জাতিগতভাবে অসম্ভব। একটা জাতির অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ নির্জনের বা হুজরায় বোসে ব্যক্তিগত ভাবে আত্মিক উন্নতি কোরতে পারে এবং ব্যক্তিগতভাবে তার ফলও ভোগ কোরতে পারে। কিন্তু তাতে জাতি উপকৃত হোতে পারে না- পারলেও তা অতি সামান্য। যদি ঐ আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভই এই উম্মাহর একমাত্র উদ্দেশ্য হতো, তবে মহানবীর (সা:) জীবনটাই অন্য রকম হতো। তিনি তাহলে একটা একটা কোরে মানুষ মুরীদ কোরে তাকে হুজরায়, খানকায় বসিয়ে দিতেন নামায, তাসবিহ মোরাকেবা, মোশাহেদা আর যিকর দিয়ে, বর্ত্তমানের ধর্মীয় নেতাদের মত। এবং তা কোরলে তদানিন্তন মোশরেক ও কাফের সমাজের সাথে তার কোন সংঘর্ষও হতো না। কারণ তখনকার মূর্ত্তিপূজক আরব সমাজে খ্রীস্টান ছিলো, ইহুদী ছিলো, এমনকি তাসাউফ প্রক্রিয়া তরিকা অনুশীলনকারী লোকও ছিলো। তদানিন্তন মোশরেক আরবরা তাদের বিরুদ্ধাচরণ কোরত না, তাদের সাথে মিলেমিশে বাস কোরত, এটা ইতিহাস। কাজেই বিশ্বনবী (সা:) যদি নতুন একটি তরিকা উদ্ভাবন কোরে তাতে লোক ভর্ত্তি শুরু কোরতেন এবং তাদের আল্লাহর নৈকট্য লাভের আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া শিক্ষা দিতেন তবে নিশ্চিত বলা যায় যে, মোশরেক সমাজ তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ কোরতো না। হযরত ওয়ায়েস করণী (রা:) শেষ নবীর (সা:) নতুন জীবন-বিধান প্রচারের অনেক আগে থেকেই তাসাউফ সাধনা কোরতেন। মোশরেক আরবরা তাকে কোন রকম বাধা দিয়েছে বা উত্যক্ত কোরেছে বোলে কোন অভিযোগ নেই। কিন্তু বিশ্বনবী (সা:) তা করেন নি। তিনি এমন এক জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, জেহাদ আরম্ভ কোরলেন যা আইন ও তাসাউফের, শরিয়াহ ও মারেফাতের ভারসাম্যযুক্ত। এর প্রথম ও প্রধান অংশ হলো আইন, যার মধ্যে মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি সর্বরকম বিধান রোয়েছে। মোশরেক আরব সমাজ বিশ্বনবীর (সা:) কার্য প্রনালী থেকে শীগগীরই বুঝতে পারলো যে, তাসাউফের মাধ্যমে স্রষ্টার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন কোরে তার নৈকট্য লাভের প্রক্রিয়া শিক্ষা দেওয়া মোহাম্মদের (সা:) লক্ষ্য নয়, তার উদ্দেশ্য হোচ্ছে তাদের সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে সেখানে নতুন আইন, নতুন সমাজ-ব্যবস্থা স্থাপন করা- একটা সম্পূর্ণ নতুন রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। তাই তারা বিশ্বনবীর (সা:) বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো।

প্রশ্ন আসে তবে কি আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভের প্রয়োজনীয়তা এ দীনে নেই? আছে, আগেই বলেছি এ দীন ভারসাম্যযুক্ত, কাজেই দুটোই আছে। কিন্তু প্রথম হলো পৃথিবীতে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত কোরে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা কোরে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা। প্রথমটা ফরজ, দ্বিতীয়টা নফল। ফরদ নামায বাদ দিয়ে শুধু সুন্নত বা নফল নামায পড়লে শরিয়াহ মোতাবেকই তা যেমন নাজায়েয, ঠিক তেমনি বিশ্বনবীর (সা:) উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্বকে পূর্ণ করার ফরদ কাজ বাদ দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রক্রিয়া অর্থাৎ নফল কাজ নিয়ে ব্যস্ত হোলে তা ঐ শরিয়াহ মোতাবেকই জায়েয হবে না। প্রথমে ফরজ তারপর ওয়াজেব, তারপর সুন্নাহ, তারপর নফলও তারপর মোস্তাহাব। এ ধারাবাহিকতার গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার প্রণালী (Priority) আল্লাহ ও তার রসুলই (সা:) বিধিবদ্ধ কোরে দিয়েছেন। সুতরাং তা ভঙ্গ কোরে অগ্রাধিকারের গুরুত্বের (Priority) ওলট-পালট যায়েজ হবে না। শুধু তাই নয় আল্লাহর হাবীবের (সা:) সুন্নাহ অর্থাৎ পৃথিবীতে এই দীনকে প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রাম বাদ দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা আল্লাহ মঞ্জুর কোরবেন কি? কারণ বিশ্বনবী (সা:) প্রদর্শিত পথ ছাড়া মুসলিমের, মো’মেনের জন্য অন্য আর কোন পথ (তরিকা) নেই। মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ (সা:) শুধু মুসলিমের নয়, সমস্ত মানব জাতির একমাত্র আশা, একমাত্র ভরসা। ঐ একটি মানুষই আল্লাহ সৃষ্টি কোরেছেন যাকে সমস্ত মানব জাতির মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করার অধিকার দেয়া হবে কিয়ামতের দিনে। অন্যান্য সমস্ত নবীদের দেয়া হবে শুধু তাদের যার যার উম্মাহর মুক্তির জন্য সুপারিশের অনুমতি। আল্লাহর নৈকট্য লাভ যদি এই শেষ জীবন-ব্যবস্থার একমাত্র লক্ষ্য হতো তবে বলবো এটা মাত্র গুটি কয়েকজন লোকের জন্য এসেছে। কারণ কোটিতে একজন লোক পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ যিনি তাসাউফের প্রক্রিয়ায় সাধনা রেয়াযাত কোরে স্রষ্টার নৈকট্য বা তার সাথে মিশে যেতে পেরেছেন। দু’চার কোটিতে একজন কোরে এমন লোক, যিনি ফানা-ফিল্লাহ বা বাকি-বিল্লাহর স্তরে পৌঁছতে পেরেছেন, সুফী তৈরী করাই যদি রসুলাল্লাহর (সা:) উপর দায়িত্ব হতো তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তার সম্পূর্ণ জীবনটাই অন্য রকম হতো, তার শিক্ষাও সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের হতো। তিনি তাহলে একটি জাতি, একটি উম্মাহ সৃষ্টি কোরতেন না, একটি সুফী তরিকার উদ্ভাবন কোরতেন। যে সশস্ত্র সংগ্রাম তিনি সারা জীবন ধোরে কোরলেন তার প্রয়োজন হতো না।

শেষ ইসলামের ভারসাম্য নষ্ট কোরে এই সুফীর দল যাকে আদর্শ হিসাবে বেছে নিলেন তিনি বিশ্বনবী (সা:) নন, তিনি মহাসাধক ওয়ায়েস করণী (রা:), যিনি রসুলাল্লাহর (সা:) নবুয়াত পাওয়ার অনেক আগে থেকেই আত্মিক উন্নতি অর্থাৎ তাসাউফের সাধনা কোরে অতি উচ্চস্তরে (মাকামে) অধিষ্ঠিত হোয়েছিলেন। শেষ প্রেরিতের নবুয়াত পাওয়ার আগে থেকেই যিনি সাধনা কোরছিলেন তিনি কী প্রক্রিয়ায় সাধনা কোরছিলেন? নিশ্চয়ই মহানবীর (সা:) শেখানো পদ্ধতিতে নয়, হয় খ্রীস্টান বা ইহুদী বা বৌদ্ধ বা হিন্দু বা অন্য যে কোন পূর্ববর্ত্তী ধর্মের পদ্ধতি হবে। তা সত্ত্বেও তার সাধনা যে সম্পূর্ণ সফল ছিলো তার প্রমাণ তার জীবনী এবং বিশেষ কোরে এই যে, মহানবী (সা:) তাঁর পবিত্র জোব্বা তাকে উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু ওয়ায়েস করণী (রঃ) বিশ্বনবীর (সা:) জীবনের কর্ম প্রবাহে যোগ দেন নি, এমন কি তাঁর (সা:) সাথে তার দেখাই হয় নি। মহানবী (সা:) আল্লাহর কাছ থেকে যে মহাদায়িত্ব নিয়ে এসে এবং তা পালন কোরতে যে অবিশ্বাস্য দুঃখ, দুর্দশার সংগ্রামের জীবন অতিবাহিত কোরলেন, তাতে ওয়ায়েস করনী (রঃ) অংশ নেন নি, মা কে ছেড়ে আসতে হয় বোলে। আবু বকর (রা:) থেকে শুরু কোরে হাজার হাজার আসহাব তাদের শুধু মা কে ছেড়ে নয়, বাপ-মা, স্ত্রী-পুত্র, কন্যা, সম্পত্তি, বাড়ী-ঘর হেলায় ত্যাগ কোরে এসে মহানবীর (সা:) সঙ্গী হোয়েছেন, তার সঙ্গে সব রকম দুঃখ বরণ কোরেছেন, বছরের পর বছর ছায়াহীন উত্তপ্ত মরুভূমিতে কাটিয়েছেন, বিশ্বনবীর (সা:) দায়িত্ব পূরণের সশস্ত্র সংগ্রামে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। সুফীরা ওহোদের যুদ্ধে বিশ্বনবীর (সা:) পবিত্র দাঁত ভেঙ্গে যাওয়ার খবরে ওয়ায়েস করণীর (রঃ) নিজের দাঁত ভেঙ্গে ফেলাকে ভালবাসার চূড়ান্ত পরিচয় হিসাবে পেশ করেন। নিজের দাঁত ভেঙ্গে ফেলা বেশী ভালবাসার পরিচয়, না প্রিয় নেতার জীবন রক্ষার জন্য তাকে ঘিরে দাড়িয়ে শত্রুর অজস্র তীর নিজেদের শরীর দিয়ে ঠেকিয়ে তীরে তীরে সজারুর মত হোয়ে যাওয়া বেশী ভালবাসার পরিচয়? শত্রুর আক্রমণ থেকে বিশ্বনবীকে (সা:) রক্ষা কোরতে জীবন পণ কোরে যুদ্ধ কোরে মারাত্মক আহত হোয়ে প্রাণের চেয়ে প্রিয় নেতার পবিত্র পায়ের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে মরে যাওয়া কতখানি ভালবাসার প্রমাণ?(এভাবেই সাহাদাত বরন করেছিলেন যিয়াদ রা:) আর যদি দাঁতের কথাই তুলেন তবে রসুলুল্লাহর (সা:) মাথায় ঢুকে যাওয়া শিরস্ত্রাণের পেরেক পাগলের মত কামড়িয়ে টেনে তুলতে যেয়ে আবু ওবায়দার (রা:) কয়েকটা দাঁত ভেঙ্গে ফেলার কথা ভূলে যাচ্ছেন কেন? ঐ ওহোদের যুদ্ধেই। লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে মাত্র যে দশজন লোককে আল্লাহর সম্পূর্ণ ক্ষমা ও জান্নাতের সুসংবাদ তাদের জীবিতকালেই দেয়া হলো আবু ওবায়দা (রা:) তাদের অন্যতম। ওয়ায়েস করনী (রা:) নন। রসুলাল্লাহর (সা:) নিজের ব্যবহৃত খেরকা ওয়ায়েস করণীকে (রা:) উপহার দেওয়াও এদের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মানের চিহ্ন হিসাবে বিবেচিত। বহু বইয়ে পড়েছি, বহু ওয়াজে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শুনেছি। কিন্তু বিদায় হজ্বে মাথার চুল কামিয়ে সমস্ত পবিত্র চুলটুকু যে মহানবী (সা:) আল্লাহর তলোয়ার খালেদ বিন ওয়ালিদ (রা:) কে উপহার দিয়েছিলেন এবং খালেদ (রা:) যে সেই মহাপবিত্র চুল গুচ্ছ তার টুপির মধ্যে সেলাই কোরে নিয়েছিলেন এবং প্রতিটি যুদ্ধে তিনি শিরস্ত্রাণের নিচে সেই টুপি পড়তেন- কই, কোন ওয়াজে, কোন বকতৃতায় তো তা শুনি না। কাপড়ের তৈরী খেরকা উপহার দেয়া বেশী মেহেরবাণীর চিহ্ন না নিজের দেহের অংশ, মাথার চুল উপহার দেয়া বেশী স্নেহের, বেশী প্রেমের চিহ্ন? ওয়ায়েজরা খালেদকে (রা:) রসুলাল্লাহর চুল উপহার দেবার কথা বলেন না- বলেন ওয়ায়েসকে (রা:) খেরকা উপহার দেয়ার কথা কারণ খালেদ (রা:) তার সমস্ত কিছু নিজের প্রাণ আল্লাহর ও তার রসূলের (সা:) জন্য উৎসর্গ কোরে অস্ত্র হাতে সংগ্রাম কোরে গেছেন সারা জীবন। ওটা অনুসরণ করা বড় কষ্ট, বড় কোরবানী, বড় জানের বিপদ। ওয়ায়েসের (রা:) কথা সর্বত্র বলেন কারণ হুজরায় বোসে আধ্যাত্মিক সাধনায়, নফল নামায, রোযায়, তসবিহ টানতে বিপদের আশংকা নেই।

সাবধান! আমি ওয়ায়েস করনীকে (রা:) ছোট করার জন্য এসব বোলছি বোলে কেউ মনে কোরবেন না। যে ভারসাম্য বিনষ্ট হোয়ে, যে আকীদা বিকৃত হোয়ে যেয়ে আজ এই জীবনব্যবস্থা পৃথিবীতে অবহেলার জিনিষ হোয়ে গেছে, এই জাতি আল্লাহ রসূলের (সা:) চোখে কার্যত মোশরেক, কাফের হোয়ে গেছে- সেই ভারসাম্য, সেই আকীদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্যই আমি লিখছি। আমি ওয়ায়েস করণীকে (রা:) ছোট করার জন্য লিখতে পারি না। কারণ যাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব, আল্লাহর রসুল (সা:) তার ব্যবহৃত কাপড় উপহার দিয়েছেন তাকে কোন রকম ছোট করা কোন মুসলিমের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া পরবর্ত্তীকালে এই মহা সাধক প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী হবার অর্থ কি তা উপলব্ধি কোরতে পেরেছিলেন বোলেই নির্জনতা ত্যাগ কোরে উম্মাহর বহির্মুখী জীবন প্রবাহে যোগ দিয়েছিলেন এবং অস্ত্র হাতে জেহাদে নেমে শহীদ হোয়েছিলেন। অর্থাৎ এই ভারসাম্যযুক্ত জীবন-ব্যবস্থার দুটো দিকেই তিনি কামেলিয়াত, সিদ্ধিলাভ কোরলেন। আমি যা বোলতে চেষ্টা কোরেছি, ওয়ায়েস করনীর (রা:) জীবন তারই দৃষ্টান্ত। কাজেই তাকে কি কোরে ছোট কোরতে পারি? তাকে ছোট কোরছেন ভারসাম্যহীন সুফীরা।

আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ, আত্মার উন্নতি করাটাই যারা ইসলামের সবটুকু মনে করেন বা অন্ততঃ প্রধান অংশ ও কর্ত্তব্য মনে করেন তারা তাদের যুক্তির পক্ষে কোর’আনে বর্ণিত খিদিরের (আ:) ঘটনা উল্লেখ করেন। প্রথম কথা হলো- সমস্ত ব্যাপারটা সাধারণ নয়- অসাধারণ। আল্লাহ তার অসীম ও সর্বব্যাপী শক্তি দিয়ে তার এই বিপুল সৃষ্টিকে চালনা করেন। কেমন কোরে তা করেন সে জ্ঞান তিনি ছাড়া আর কারোরই নেই। মুফাস্সিরদের মতে কোর’আনে বর্ণিত ঘটনাটার কারণ হলো এই যে, একবার মুসার (আ:) মনে এই ধারণা হলো যে, যেহেতু তিনি আল্লাহর নবী কাজেই সব রকম জ্ঞানই তাকে দেয়া হোয়েছে এবং তার চেয়ে বেশী জ্ঞানী আর কেউ নেই। তার এই ভুল ধারণা অপনোদন করার জন্য আল্লাহ তাকে খিদিরের (আ:) সঙ্গে দেখা করিয়ে দিলেন এবং মুসার (আ:) ভুল ভাঙ্গলো। আল্লাহ যে রহস্যময় ভাবে তার সৃষ্টি পরিচালনা করেন খিদির (আ:) তার একটি মাধ্যম মাত্র। আর নবুয়াত হলো মানুষ কেমন কোরে পৃথিবীতে শান্তিতে অর্থাৎ ইসলামে বাস কোরবে সেই জীবন-ব্যবস্থার জ্ঞান ও শিক্ষা। দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার, ভিন্ন জ্ঞান। এই দুটো জ্ঞানের মধ্যে নবীদের মাধ্যমে আল্লাহর দেয়া জ্ঞানই হোচ্ছে আমাদের জন্য। স্রষ্টা কেমন কোরে তার সৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করেন তা জাতি অর্থাৎ নবীদের উম্মাহ হিসাবে আমাদের জন্য নয়। তা না হলে মুসাকে (আ:) নবী না কোরে আল্লাহ তো খিদির (আ:) কেই নবী বানাতে পারতেন এবং তা হোলে খিদিরের (আ:) ঐ বিশেষ জ্ঞানই তার উম্মাহর জন্য নির্দিষ্ট হোয়ে যেতো। দ্বিতীয়তঃ খিদিরকে (আ:) চিরজীবি বলা হয়। আল্লাহ বোলেছেন- প্রত্যেক জীবকে মরতে হবে। খিদির যদি চিরজীবী হোয়ে থাকেন তবে প্রশ্ন উঠে তিনি আমাদের মত মানুষ বা কোন জীব কিনা তার নাম খিদির অর্থাৎ সবুজ বা চির সবুজ- নামটাই তো এ ব্যাপারে সন্দেহজনক। তৃতীয়তঃ খিদিরের (আ:) জ্ঞান হলো এক বিশেষ জ্ঞান, যাকে বলা যায় Specialised Knowledge কিন্তু বিশেষ বোলেই সেটা মুসার (আ:) জ্ঞানের চেয়ে উচ্চতর কিছু তা মনে করার কোন কারণ নেই। ধরুন কোন দেশ
বা জাতির সর্বময় প্রধান। তিনি জ্ঞানী, গুনী, সুশাসক, সুবিচারক। তার জাতির মধ্যে অনেক বিশেষ গুণধারী মানুষ আছেন। চিকিৎসক আছেন, প্রকৌশলী, নৌবিদ্যা বিশারদ, সামরিক বিশেষজ্ঞ, সেচ বিভাগীয় বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি আছেন। ঐ শাসক ঐ সব বিশেষজ্ঞদের সব জ্ঞানের অধিকারী নন- কিন্তু তাই বোলে তিনি যে জাতির সর্বময় কর্ত্তা তা বদলাবে না। ঐ বিশেষজ্ঞরা তাদের যার যার জ্ঞান ঐ শাসককে শেখাতে পারেন। কিন্তু তারা তাদের ঐ বিশেষ জ্ঞান (Specialised Knowledge) নিয়েও ঐ শাসকের অধীন, তার আদেশ অনুযায়ী চলেন। চতুর্থ কথা হলোঃ খিদির (আ:) মুসাকে (আ:) যে কয়টি কাজ কোরে দেখালেন সে গুলির প্রতি লক্ষ্য কোরে দেখুন। নৌকা ছিদ্র কোরে একজনের নৌকাটা রক্ষা কোরলেন। একটা ছেলেকে হত্যা কোরে তার বাপ মাকে এক ভবিষ্যত দুষকৃতিকারী সন্তানের হাত থেকে রক্ষা কোরলেন এবং একটি দেয়াল মেরামত কোরে একজনের সম্পত্তি রক্ষা কোরলেন। এই তিনটি কাজের প্রত্যেকটিই ব্যক্তিগত ব্যাপারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কোনটিই জাতিগত অর্থাৎ বৃহত্তর নয়। অন্যদিকে মুসার (আ:) কাজ
ছিলো জাতির জন্য এমন এক জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেটার প্রতিষ্ঠা হোলে হয়ত জবর দখলকারী ঐ রাজারই অস্তিত্ব থাকতো না, ঐ দুষকৃতিকারী ছেলে দুষকৃতিকারী হতো না এবং এমন সমাজ সৃষ্টি হতো যে সমাজ ঐ ইয়াতীম বালকের সম্পদ রক্ষা কোরে যথা সময়ে তাকে দিয়ে দিতো। আসল কথা হলো কোর’আনে ঐ ঘটনা মুসার (আ:) নিজের সম্বন্ধে একটা ভুল ধারণা ভেঙ্গে দেয়ার জন্য। ওটাকে যদি আমাদের প্রধান কর্ত্তব্য বোলে নিয়ে ঐ নিয়ে মাতামাতি করি তবে পথভ্রষ্ট হোতে হবে।

তাহলে সুফীদের প্রবর্ত্তিত এই -তাসাউফ কি? আদম (আ:) থেকে শেষ নবী (সা:) পর্য্যন্ত আল্লাহ এই দীন-এ ইসলাম পাঠিয়েছেন একটা ভারসাম্য দিয়ে। প্রত্যেকটিতে একদিকে যেমন মানুষের জন্য রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিধান রোয়েছে-তেমনি তার আত্মার উন্নতির প্রক্রিয়াও রোয়েছে। দু’দিকেই সমান এবং একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা একেবারে অচল। মানুষ যেমন দুপায়ে চলে, এক পায়ে চোলতে পারে না, দীনও একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা একা চোলতে পারে না। আত্মার উন্নতির প্রক্রিয়া পূর্ববর্ত্তী সমস্ত দীনেই ছিলো, বিকৃত অবস্থায় আজও আছে এবং ঐ পূর্ববর্ত্তী ধর্ম গুলোর প্রক্রিয়ায় সাধনা কোরলে আজও ফল পাওয়া যায়। আজও অন্যান্য ধর্মে অতি শক্তিশালী মহা সাধকরা আছেন যাদের কেরামত অলৌকিক ক্ষমতা মুসলিম ওলী, আওলিয়াদের চেয়ে কম নয়। যে কেউ-ই নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় সাধনা কোরলে তার ফল পাবে, তার আত্মার শক্তি বৃদ্ধি পাবে, অদৃশ্যের, গায়েবের অনেক খবর তার কাছে আসবে, সাধারণ মানুষ যা পারে না তেমন কাজ করার ক্ষমতা জন্মাবে, এক কথায় তাসাউফের বই-কেতাবে যে সব উন্নতির কথা লেখা আছে সবই হবে। কিন্তু এ শেখাতে বিশ্বনবী (সা:) আসেন নি। এই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুফী ও আলেম, হাকীম-আল-উম্মাহ আশরাফ আলী থানভী (রঃ) লিখেছেন- “মানব শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যেমন জাহিরী (প্রকাশ্য) শক্তি রহিয়াছে। সেইরূপে মানুষের রূহের (আত্মার) মধ্যে অনেক বাতেনী ( গুপ্ত) শক্তি নিহিত আছে। শরীর চর্চার মাধ্যমে যেমন মানুষের অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে শক্তিশালী হইয়া উঠে, তদ্রুপ আধ্যাত্মিক সাধনার দ্বারা তাহাদের রূহানী শক্তি বৃদ্ধি পায়(সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ- ইসলামিক ফাউণ্ডেশন-১ম খণ্ড ৭৬ পৃঃ।)। আশরাফ আলী থানভী প্রকৃত সত্য কথা লিখেছেন এবং সে সাধনার কথা লিখেছেন যে সাধনার প্রক্রিয়া প্রতিটি ধর্মেই আছে। শুধু এই প্রক্রিয়া শেখাতে শেষনবী (সা:) আসেন নি। আল্লামা আযাদ সোবহানী লিখেছেন- “মোহাম্মদকে (সা:) একটি বিরাট গাছ হিসাবে নিলে তাসাউফ তার একটা ডাল মাত্র।” আমিতো শারিয়াহ ও তাসাওয়াফকে মোটামুটি অর্দ্ধেক অর্দ্ধেক ভাগ কোরেছি, দুটো পা বোলে, আল্লামা সোবহানী তাওসায়াফকে একটি ডালের চেয়ে বেশী বলেন নি।

তাসাউফের প্রক্রিয়ায় সাধনা কোরে আত্মার উন্নতি কোরে আল্লাহর নৈকট্য লাভ যে এই দীনের মুখ্য উদ্দেশ্য নয় তার চূড়ান্ত প্রমাণ এই হাদিসটি-
হিজরতের আগে, যখন মোশরেকদের অমানুষিক অত্যাচার, নির্য্যতন মুষ্ঠিমেয় মুসলিমদের অসহ্য হোয়ে উঠেছে অথচ তারা অসহায়, কিছু করার নেই, তখন একদিন এক সাহাবা বিশ্বনবীকে (সা:) বোললেন- হে আল্লাহর রসুল! আপনি দোয়া কোরুন যাতে এই মোশরেকরা ধ্বংস হোয়ে যায়। এটা ইতিহাস যে মানব জাতির মুকুটমনি (সা:) জীবনে খুব কমই রাগান্তিত হোয়েছেন। সেদিন ঐ সাহাবার কথা শুনে তিনি রেগে গিয়েছেলেন এবং বোলেছিলেন- শীগগীরই এমন সময় আসছে যখন একটি মেয়ে লোক একা সানা থেকে হাদরামাউত পর্য্যন্ত ভ্রমণ কোরতে পারবে, তার মনে এক আল্লাহ এবং বন্য পশু ছাড়া আর কিছুরই ভয় করার থাকবে না(হাদীস- খাব্বাব রা: থেকে বোখারী, মেশকাত)। বিশ্বনবীর (সা:) কথাটার ভেতরে প্রবেশ কোরুন। তিনি কি বোললেন? তিনি ইংগিত দিলেন, এত বাধা, এত অত্যাচার সত্ত্বেও তিনি সফল হবেন এবং যাদের ধ্বংস করার জন্য ঐ সাহাবা দোয়া কোরতে বোলছেন তারাই এমন বদলে যাবে এবং তাদের দিয়েই এমন একটি রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে যেখানে একা একটা মেয়ে মানুষ কয়েক শ’মাইল পথ নির্ভয়ে চলে যেতে পারবে। রসুলাল্লাহ (সা:) তার সাহাবাকে যে উত্তরটি দিলেন তা দিয়ে শুধু একটি মাত্র কথা বোঝায় আর তা হলো এই যে, তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হোচ্ছে এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা যেখানে ন্যায়-বিচার, আইন-শৃঙ্খলা ও জনসাধারণের নিরাপত্তা এমন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, একা একটি মেয়ে মানুষও ঐ দূরত্বের পথে চোলতে কোন ভয়ই কোরবে না। তিনি ঐ সাহাবার জবাবে এ কথা বোললেন না যে, এমন সময় আসছে যখন এই সব মোশরেক ও কাফেররা দলে দলে মসজিদে যেয়ে নামাজ পড়বে, রোযা রাখবে, হজ্ব কোরবে, যাকাত দেবে, দাড়ি রাখবে, টুপি পরবে, চিল্লায়, খানকায় বোসে মোরাকাবা কোরবে, যিকর কোরবে। তার কথার একমাত্র অর্থ হোচ্ছে, এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও এমন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব শুধুমাত্র আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা মানুষের সার্বিক জীবনে প্রতিষ্ঠা হোলে, এবং তাই ছিলো বিশ্বনবীর (সা:) জীবনের উদ্দেশ্য। এবং ঐ উদ্দেশ্য পূরণ ফিকাহর বিশ্লেষণ কোরেও হবে না, খানকায় বোসে রেয়াযাত কোরেও পাওয়া যাবে না। শুধু পাওয়া যাবে না নয়, ফিকাহর বিশ্লেষণ ও খানকায় তসবিহ টপকানো বিশ্বনবীর (সা:) জীবনের উদ্দেশ্য কেই ব্যর্থ কোরে দেবে, এবং দেবে নয়- দিয়েছে। তার জীবনের উদ্দেশ্যকে পূর্ণ কোরতে পারে শুধুমাত্র দীনুল কাইয়্যেমাকে, সেরাতুল মোস্তকীমকে আকড়ে ধোরে রেখে একতাবদ্ধ হোয়ে, সশস্ত্র সংগ্রাম কোরে যাওয়ার পথে। রসুলাল্লাহ (সা:) সেদিন ঐ সাহাবার কথার উত্তরে যে ভবিষ্যত বাণী কোরেছিলেন তা কিছুদিনের মধ্যেই সত্যে পরিণত হোয়েছিলো এটা ইতিহাস। এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোয়েছিলো যে রাষ্ট্রে অন্যায় অবিচার লুপ্ত হোয়ে গিয়েছিলো, সম্পত্তি ও জীবনের নিরাপত্তা এমন পর্য্যায়ে পৌঁছেছিলো যে সত্যই একজন মেয়ে মানুষ আরবের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্য্যন্ত নির্ভয়ে ভ্রমণ কোরতে পারতো। কিন্তু বিশ্বনবীর (সা:) প্রতিষ্ঠিত ঐ রাষ্ট্র ফকিহ ও মুফাসসিরদের অতি বিশ্লেষণ দিয়েও হয় নি, আধ্যাত্মিক সাধকদের খানকায় বোসে মোরাকেবা দিয়েও হয় নি, হোয়েছে বিশ্বনবীর (সা:) ও তার আসহাব মুজাহিদদের (রা:) অবিশ্রান্ত সশস্ত্র সংগ্রামের ফলে। এটা ইতিহাস এবং এটাও ইতিহাস যে আমাদের ফকিহ ও সুফীদের জন্ম হোয়েছে বহু পরে। মহানবী (সা:) ও তার আসহাবদের কেউই হুজরায় বা খানকায় বসেন নি।

Leave a Reply