পহেলা বৈশাখ অনৈসলামিক উৎসব?

0
হেযবুত তাওহীদ
Feb 26, 2023 05:00 PM 1 Answers শিল্প-সংস্কৃতিতে হেযবুত তওহীদ
Member Since Jul 2022
Subscribed Subscribe Not subscribe
Flag(0)

প্রচলিত ধারণা মতে পহেলা বৈশাখ একটি অনৈসলামিক উৎসব। কিন্তু হেযবুত তওহীদ এই ধরনের অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদান করে কীভাবে?

0 Subscribers
Submit Answer
Please login to submit answer.
1 Answers
Best Answer
0
হেযবুত তাওহীদ
Feb 26, 2023
Flag(0)

আমাদের দেশের অনেক আলেম ও মুফতির দৃষ্টিতে চৈত্র সংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখ, নবান্ন উৎসব ইত্যাদি উদ্যাপন করা প্রকৃতপক্ষে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি, শেরক ও বেদাত। তাদের জ্ঞানের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলছি, এ বিষয়ে আমাদের কিঞ্চিৎ দ্বিমত রয়েছে। দু’টি দিক থেকে বিষয়টি উপস্থাপনের চেষ্টা করছি,

(ক) ইসলামের আকীদা।

(খ) শরিয়াহ।

ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা যা সমগ্র মানবজাতির উপযোগী করে আল্লাহ রচনা করেছেন। এতে যে বিধানগুলো স্থান পেয়েছে সেগুলো কোনোটাই কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিটি জনপদের মানুষের একটি নিজস্ব সংস্কৃতি থাকে যা তাদের ভৌগোলিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিশীল, যা গড়ে ওঠে হাজার হাজার বছরের ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে। ইসলাম কোনো বিশেষ অঞ্চলের সংস্কৃতিকে অন্য অঞ্চলের উপর চাপিয়ে দেয় নি, তেমনি কোনো আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে নিষিদ্ধও করে নি। ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে কেবল অশ্লীলতা, অন্যায় ও আল্লাহর নাফরমানিকে। সে বিচারে আমাদের দেশে আবহমান কাল থেকে চলে আসা নবান্ন উৎসব, চৈত্র সংক্রান্তি বা পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি কোনো উৎসবই শরিয়ত পরিপন্থী হতে পারে না। তবে উৎসবের নামে যদি অশ্লীলতা, অপচয় ও অন্যায়ের বিস্তার ঘটানো হয়, সেটা অবশ্যই নিষিদ্ধ। কেননা, তার দ্বারা মানবসমাজে অশান্তি সাধিত হবে এবং যা কিছুই অশান্তির কারণ তা-ই যে কোনো জীবনব্যবস্থায় নিষিদ্ধ হওয়ার দাবি রাখে। একজন বাংলাদেশি নেতা বাংলায় কথা বলবেন, বাঙালি পোষাক পরবেন এটাই স্বাভাবিক। তেমনি আল্লাহর শেষ রসুল আরবে এসেছেন, তাঁর আসহাবগণও আরবের মানুষ হিসাবে স্বভাবতই আরবীয় সংস্কৃতির পোষাক, ভাষা, আচার-আচরণ, রুচি-অভিরুচি, খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করতেন। কিন্তু এর সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ আমাদের সমাজে ইসলামী সংস্কৃতির নামে আরবীয় সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যেমন: ইসলামের অধিকাংশ আলেমদের সিদ্ধান্তমতে পুরুষের ছতর হলো নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকতে হবে। এখন কেউ যদি ধুতি পরিধান করে তাহলেও কিন্তু তার ছতর আবৃত হয়। কিন্তু ধুতি পরাকে কি আলেমরা ইসলামী সংস্কৃতি বলে মেনে নেবেন? না। তারা চান মানুষকে তেমন জোব্বা পরাতে যেটা আরবের লোকেরা পরে থাকেন।

বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি বলতে কৃষি সংস্কৃতিই বোঝায়। বাংলার কৃষক ধর্মে হিন্দু বা মুসলিম যেটাই হোক, তার জীবনের আনন্দ, বেদনা, উৎসব, আশা-নিরাশার সঙ্গে ফসল ও ফসলী বছরের নিবিড় বন্ধন থাকবে এ কথা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়। তাই চৈত্রসংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখ, নবান্ন উৎসব ইত্যাদি কৃষিনির্ভর বাঙালির জীবনমানের মানদণ্ড।

এই উৎসবগুলো কি ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ না অবৈধ? শরিয়তের মানদণ্ড হচ্ছে, আল্লাহ নির্দিষ্টভাবে যে বিষয় বা বস্তুগুলোকে হারাম করেছেন তার বাইরে সবই হালাল বা বৈধ। এছাড়া কোনো বিষয় (যেমন একটি উৎসব) হালাল না হারাম তা নির্ভর করে তার উদ্দেশ্য ও ফলাফলের উপর। কোনো কাজের উদ্দেশ্য বা পরিণতি যদি মানুষের অনিষ্টের কারণ হয় তাহলে সেটা কখনোই ইসলাম সমর্থন করে না। আর যদি তার উদ্দেশ্য হয় মানুষের কল্যাণ তাহলে একে হারাম ফতোয়া দেওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। আমরা পবিত্র কোর’আনে কৃষি-সংস্কৃতির দিবস উদযাপন প্রসঙ্গে আল্লাহর নীতিমালা জানতে পারি। আল্লাহ বলছেন, তিনিই লতা ও বৃক্ষ-উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং খেজুর বৃক্ষ, বিভিন্ন স্বাদ বিশিষ্ট খাদ্যশস্য, জলপাই ও ডালিম জাতীয় ফলও সৃষ্ট করেছেন। এইগুলো একে অন্যের সদৃশ এবং সাদৃশ্যহীন। যখন তা ফলবান হয় তখন তার ফল আহার করবে আর ফসল তোলার দিনে (ইয়াওমুল হাসাদ) এগুলোর হক প্রদান করবে এবং অপচয় করবে না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না (সুরা আন’আম: ১৪১)।

এ আয়াতে তিনটি শব্দ লক্ষণীয়, (ক) ফসল তোলার দিন, (খ) হক আদায় করা, (গ) অপচয় না করা। কোরআনের প্রসিদ্ধ ইংরেজি অনুবাদগুলোতে (যেমন আল্লামা ইউসুফ আলী, মারমাডিউক পিকথল) ফসল তোলার দিনের অনুবাদ করা হয়েছে। আয়াতটিতে আমরা কয়েকটি বিষয় পাচ্ছি:

১. ফল বা ফসল তোলার দিন এর হক আদায় করতে হবে। সেই হক হচ্ছে- এর একটি নির্দিষ্ট অংশ হিসাব করে গরিব মানুষকে বিলিয়ে দিতে হবে। ফসলের এই বাধ্যতামূলক যাকাতকে বলা হয় ওশর।

২. যেদিন নতুন ফসল কৃষকের ঘরে উঠবে সেদিন স্বভাবতই কৃষকের আনন্দ হবে। যে কোনো আনন্দই পূর্ণতা পায় অপরের মধ্যে তা সঞ্চারিত করার মাধ্যমে। নতুন ফসল তোলার আনন্দের ভাগিদার যেন গরিবরাও হতে পারে সেজন্য তাদের অধিকার প্রদান করে তাদের মুখেও হাসি এনে দিতে হবে। কিন্তু আল্লাহ সাবধান করে দিলেন এই আনন্দের আতিশয্যে যেন কেউ অপচয় না করে।

আমাদের দেশে ফসল কাটার দিনে আনন্দ করা হয়, বিভিন্ন ফসলের জন্য বিভিন্ন পার্বণ পালন করা হয়। এ আয়াতের প্রেক্ষিতে দেখা গেল এই দিবসগুলোতে উল্লিখিত কাজগুলো করা ফরদ। কেবল ইসলামের শেষ সংস্করণ নয়, মুসা (আ.) এর উপর যে শরিয়ত নাজেল হয়েছিল সেখানেও আল্লাহ বলেন, “তুমি ফসল কাটার উৎসব অর্থাৎ ক্ষেতে যা কিছু বুনেছ তার প্রথম ফসলের উৎসব পালন করবে। বছর শেষে ক্ষেত থেকে ফসল সংগ্রহ করার সময় ফলসঞ্চয় উৎসব পালন করবে” (তওরাত: এক্সোডাস ২৩:১৬)। সুতরাং আল্লাহর হুকুম মোতাবেকই বিভিন্ন জনপদে বিভিন্ন আঞ্চলিক উৎসব প্রচলিত হয়েছে।

কিন্তু বর্তমানে যেভাবে দিবসগুলো পালিত হচ্ছে সেটাও সঠিক নয়। ক্রিসমাস, ঈদ, পূজা ইত্যাদি ধর্মীয় উৎসব হলেও বাস্তবে এগুলোর আসল উদ্দেশ্য ধর্মানুরাগ নয়, গরিবের মুখে হাসি ফোটানোও নয়। এগুলোর নিরেট উদ্দেশ্য বাণিজ্যিক স্বার্থ। পহেলা বৈশাখও তাই। এদিন একটি ৫০০ টাকার ইলিশের দাম হয়ে যায় ১০,০০০ টাকা, যা সেই দরিদ্র কৃষকের ধরাছোঁয়ার সম্পূর্ণ বাইরে থাকে। অপরপক্ষে যারা সারা বছর বার্গার, পিজা খায় তারা এই একদিন মাটির বাসনে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার জন্য হা-পিত্তেশ করেন; যেন একদিনের মাতৃভক্তি, দিন শেষ ভক্তি শেষ। ব্যবসায়ী শ্রেণি ও মিডিয়ার প্রচারণায় ভুলে আমাদের তারুণ্যও উন্মাদনা আর অপচয়ে মত্ত হয়ে যাচ্ছে। বহিঃর্বিশ্বেও এমনই হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার শিনচিলা শহরে প্রতিবছর উদযাপিত তরমুজ উৎসবে হাজার হাজার তরমুজের রস দিয়ে পিচ্ছিল পথ তৈরি করে তাতে স্কি করা হয়। বিভিন্ন দেশে আঙ্গুর, টমাটো ইত্যাদি নিয়েও অপচয়ের মহোৎসব হয়। কিন্তু আল্লাহ বলেছেন, “খাও, পান কর, কিন্তু অপচয় করো না।… হে রসুল! আপনি বলে দিন, কে হারাম করেছে সাজসজ্জা গ্রহণ করাকে–যা আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন?” (সুরা আরাফ ৩১-৩২)। অর্থাৎ আনন্দ ফুর্তি, সাজগোজ করতে আল্লাহ নিষেধ করেন নি। এই মুহূর্তে পৃথিবীতে প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ আছে যারা দুর্ভিক্ষপীড়িত, আমাদের দেশেও অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। এই মানুষগুলোর হক আছে আল্লাহ প্রদত্ত সকল ফল ও ফসলে, এই নবান্নে, পহেলা বৈশাখে, চৈত্রসংক্রান্তির পার্বণে। তাদের সেই হক আদায় করা হলেই এই উৎসব হবে পবিত্র দিন। উৎসব আর ঈদ আসলে একই কথা। উৎসবের নামে আজ অর্থের যে নিদারুণ অপচয় হচ্ছে, বাণিজ্যিক স্বার্থ হাসিল করা হচ্ছে তা না করে যদি আল্লাহর হুকুম মোতাবেক গরিব-দুখী মানুষকে তাদের অধিকার প্রদান করা হতো, তাহলে এ আনন্দ পূর্ণতা পেত, আর এই উৎসবগুলো এবাদতে পরিণত হতো।

Sign in to Reply
Replying as Submit

Leave a Reply