সুস্থ ধারার সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী?
আমাদের সমাজে শিল্প ও সংস্কৃতির পথেও সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধর্মের অপব্যাখ্যা। আমাদের সমাজে যারা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছেন তাদের অনেকের মধ্যেই একটা দ্বিধা ও অপরাধবোধ আজীবন কাজ করে। কেননা তারা মনে করেন যে, তারা খুব গোনাহের কাজ করছেন। ফলে প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ হচ্ছে না।
আবার অনেক সংস্কৃতিমনা মানুষ ধর্মের নামে চলা কূপমণ্ডূকতাকে মেনে নিতে না পেরে ধর্ম বিদ্বেষী হয়ে গেছেন। তারা দেখছেন ধর্মান্ধরা কীভাবে বোমা মেরে সুপ্রাচীন নান্দনিক ভাস্কর্যগুলো গুড়িয়ে দিচ্ছে, সঙ্গীতানুষ্ঠানে, সিনেমা হলে বোমা হামলা করছে। এসব দেখে ধর্মবিদ্বেষীরা ধর্মকেই গালাগালি করছেন পত্রিকায়, চলচ্চিত্রে, যা ধর্মপ্রাণ মানুষকে আহত করছে, ধর্মব্যবসায়ীরাও পেয়ে যাচ্ছে দাঙ্গা সৃষ্টি করার সুযোগ। তারা খোদ চলচ্চিত্র, ব্লগ ও শিল্পমাধ্যমকেই প্রতিপক্ষে পরিণত করছে।
এ বিষয়ে হেযবুত তওহীদের বক্তব্য হচ্ছে, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি বা শিল্প যে কোনো কিছুরই ভালো-মন্দ নির্ভর করে তার ব্যবহারের উপর। শিল্পের নামে অশ্লীলতা, মিথ্যা ও অন্যায়ের প্রসার শুধু ধর্মে নয় বিশ্বের সমস্ত আইনেও নিষিদ্ধ হওয়ার দাবি রাখে, কিন্তু সুস্থধারার শিল্পচর্চা নিষিদ্ধ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
আল্লাহর রসুল কি সঙ্গীত, শিল্প-সাহিত্যের প্রতি বিরূপ ছিলেন? না, ইতিহাসের এই ব্যস্ততম মহামানব যাঁর নবী জীবনের প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামে, তাঁর পক্ষে শিল্পচর্চায় মেতে থাকা সম্ভব ছিল না। তথাপি এত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি গান শুনেছেন। আরবের বিভিন্ন ঐতিহাসিক দিবসে, বিবাহে, যুদ্ধে সর্বত্র গানের চর্চা ছিল, রসুলাল্লাহ সেগুলোকে উৎসাহিত করেছেন। মিনার এক উৎসবের দিন আবু বকর (রা.) আম্মা আয়েশার (রা.) ঘরে এসে দেখেন দু’টি মেয়ে দফ বা তাম্বুরা সহযোগে গান গাইছে। নবীগৃহে গান-বাজনা দেখে আবু বকর (রা.) কন্যা আয়েশাকে তিরস্কার করতে আরম্ভ করলেন। তখন মহানবী বললেন, ‘আবু বকর! ওদেরকে বিরক্ত করো না, আজ ওদের উৎসবের দিন (বোখারি, মুসলিম)। এমন কি আল্লাহর রসুল নিজে একজন আনসার সাহাবির বিয়ের আসরে গায়ক রাখার হুকুম দিয়েছেন, কেননা আনসারেরা ছিলেন গোত্রীয়ভাবে সঙ্গীতপ্রিয়। অথচ বর্তমানে কেবল হামদ-নাত জাতীয় সঙ্গীত গাওয়াকেই আলেমগণ বৈধ বলে মনে করে থাকেন। তাদের কাছে স্বাধীনতা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি বা পহেলা বৈশাখের গান দূরে থাক, কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীতও সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
কোন ধর্মই শিল্পকলাকে নাজায়েজ করতে পারে না। কেননা স্বয়ং স্রষ্টাই সুর ও নৃত্যকলা সৃষ্টি করেছেন। প্রজাপতির ডানায় তিনি এঁকেছেন মনোমুগ্ধকর আল্পনা। শেষ প্রেরিত গ্রন্থ আল-কোরআনকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন ছন্দবদ্ধ করে। কেবল কোরআন নয়, যবুর, গীতা, পুরান, ত্রিপিটক ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থও আল্লাহ পাঠিয়েছেন কাব্যময় কোরে। গীতা শব্দের অর্থই তো গান। অনেক আলেম মনে করেন, ইসলামী গান করা বৈধ হলেও সেটা বাদ্য বাজিয়ে গাওয়া যাবে না। কিন্তু ইমাম আবু হামিদ আল-গাজ্জালী তাঁর ‘এহইয়াও উলুমদ্দিন’নামক গ্রন্থে লিখেছেন, “কোকিলের সুর শোনা যেমন হারাম নয়, তেমনি মানুষের ইচ্ছা মোতাবেক কণ্ঠ নিঃসৃত সুর শ্রবণ করাও হারাম নয়। প্রাণহীন যন্ত্রের সুর এবং প্রাণীর স্বর পৃথক নয়। মানুষের কণ্ঠ নিঃসৃত সুর, বিভিন্ন তারযন্ত্রের ওপর আঘাত বা ঘর্ষণজনিত আওয়াজ, দফ, তবলা বা অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজও হারাম নয়”।
আমাদের কথা হচ্ছে, একজন লেখকের কলমের কালী যদি শহীদের রক্তের চেয়ে পবিত্র হতে পারে তবে একজন গায়কের গান যদি মানুষকে মানবকল্যাণে আত্মদান করতে উদ্বুদ্ধ করে, তখন সে গান কেন ইবাদত বলে গণ্য হবে না? তাই আল্লাহ যাদেরকে শিল্পপ্রতিভা দান করেছেন তাদেরকে এর হক আদায় করতে হলে এই গুণকে স্বার্থহাসিলের জন্য ব্যবহার না করে মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে।